তারিক মুজিব ।।
শাওয়াল এবং যিলকদ মাস ইসলামি প্রকাশনীগুলোর বসন্ত কাল। বাকী ১০ মাসে এসব প্রকাশনীর বই-কিতাব যা বিক্রয় হয় রমযান পরবর্তী দুইমাসে তার চেয়ে বেশি বিক্রয় হয়। তবে এ বছরের চিত্র সম্পূর্ণই ভিন্ন।
চলমান করোনা পরিস্থিতি অন্যসব অঙ্গনের মতো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রকাশনা জগতও। পাশাপাশি লাইব্রেরি ব্যবসা পড়েছে মুখ থুবড়ে। ইসলামি বই প্রকাশ এবং বিক্রয়ের প্রাণকেন্দ্র বাংলাবাজার থেকে অনেকে দোকান তুলে নিয়েছে। ব্যাবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকেই।
করোনায় কেমন ক্ষতি হলো- জানতে চাইলে মাকতাবাতুল আযহারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা উবাইদুল্লাহ জানান, আল্লাহর রহমতে আমরা এখনো টিকে আছি। গত কয়েক বছরে ব্যবসায় ভালো উন্নতি করা আমাদের পরিচিত অনেকেই ইতোমধ্যে সবকিছু গুটিয়ে নিয়েছেন। সে হিসেবে শুকরিয়া আদায় করছি। তবে করোনায় আমাদের কী পরিমাণ ক্ষতি হলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু শাওয়াল মাসেই সারাবছরের অর্ধেক বই-কিতাব আমাদের বিক্রয় হতো। অপরদিকে এই সময়ের ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য মিশর, পাকিস্তান, বৈরুত থেকে আমাদের অর্ডার করা কিতাব আনতে হয়েছে। যেগুলো এখন বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ বলেন, অথচ অর্ডারগুলো গ্রহণ করতে পোর্টে আমাদের অতিরিক্ত তিন লাখ টাকা প্রদান করতে হয়েছে। পোর্ট থেকে বলে দেওয়া হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ছাড়পত্র নিতে। আর করোনার কারণে ফাউন্ডেশন ছিল বন্ধ। এজাতীয় সমন্বয়হীনতার কারণেও আমাদের অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
মিরপুর ১০ নাম্বারের ক্ষুদ্র কিতাব ব্যাবসায়ী মুহাম্মদ সাঈদুর রহমান। রমযান পরবর্তী সময়ে কওমি মাদরাসার কিতাব বিক্রি করে সারাবছর দিন গুযরানের বন্দোবস্ত করেন। বছরের অন্যসময় অতি সামান্য কেনাকাটা হলেও শাওয়াল মাসের আয় দিয়েই তার নির্বিঘ্নে চলে যেতো। এ বছর কয়েক হাজার টাকার কিতাবও বিক্রি করতে পারেননি। স্বভাবতই হতাশ তিনি। এদিকে দোকান ভাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে। দোকানের সহকারী দুইজনকে ‘না’ করে দিয়েছেন।
নীলক্ষেতে কিতাব ছাপেন মুন্সী আবদুল হালিম। অন্যবছর এই সময়টাতে একটুও বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসত পেতেন না। এ বছর শাওয়াল মাস পেরিয়ে গেলেও একটা অর্ডার আসেনি তার কাছে। এই মাস শেষে দোকান ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাবেন বলে জানান মুন্সী আবদুল হালিম।
ছোট ছোট প্রকাশনা, লাইব্রেরি এবং প্রিন্টার্সগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও টিকে থাকার তাগিদে ব্যবসাকে অনলাইনমুখী করছে পরিচিত প্রকাশনীগুলো।
মাকতাবাতুল আযহারের মাওলানা উবাইদুল্লাহ জানান, তাদের প্রকাশিত এবং বিদেশ থেকে আনা কিতাবগুলো নিয়মিত অনলাইনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। ফেসবুকে বুস্ট করা হচ্ছে। পাঠক এবং ক্রেতারা মেসেঞ্জার, হোয়াটস্যাপে অর্ডার করছেন। কিতাব দেখছেন। দূর থেকে অনেকে ফোনকলের মাধ্যমে অর্ডার করছেন। যেগুলো পরে কুরিয়ার করে দেওয়া হচ্ছে। এতে মন্দাভাব কিছুটা হলেও কাটছে বলে জানান মাওলানা উবাইদুল্লাহ।
‘‘তবে এভাবে ব্যাবসা কতদূর টিকবে বলা মুশকিল। গোডাউন ভাড়া, সহকারীদের বেতন-বোনাস মিলিয়ে প্রতিমাসে আমার কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় হচ্ছে। যত ব্যয় হচ্ছে কিতাব বিক্রি করে সেটুকু যদি আয় না করা যায় তাহলে তো ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে’’। হতাশার সাথে বলেন মাকতাবাতুল আযহারের পরিচালক।
‘‘পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে সামনে মাদরাসা খোলা হলেও ক্ষতির জের টানতে হবে দীর্ঘদিন। চলাফেরা স্বাভাবিক হলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার যে পতন হয়েছে তা ফিরতে ফিরতে অনেকদিন লেগে যাবে। আগে যে ব্যক্তি কয়েক লাখ টাকার কিতাব কিনতেন এখন তিনি পরিমাণ হাজারের ঘরে নামিয়ে আনবেন নির্ঘাত। সবার জীবনেই তো করোনার নির্মম প্রভাব পড়েছে’’। বলছিলেন আরেক প্রকাশক।