মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব।।
অনলাইনে বেচাকেনার বয়স বাংলাদেশে একেবারে কম নয়। যদিও এতে অভ্যস্ত হতে মানুষের সময় লেগেছে। দীর্ঘদিন উদ্যোক্তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে এখন বলা যায়, বিপুল সংখ্যক মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেজন্য খুব সাধারণ জিনিসও এখন মানুষ অনলাইনে কিনে। এমনকি হোটেলের রান্না করা খাবারও নাকি কিনে!
অনলাইন মার্কেটিং সারাদেশে চললেও শহরে চলে বেশি। তারমধ্যে হয়ত ঢাকা শহরে চলে সবচে বেশি। কিন্তু এই শহরে দীর্ঘদিন ধরে থাকা হলেও কখনো অনলাইনে কেনাকাটা করিনি। বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে নিয়মিতই। রাস্তার বিলবোর্ডে, পত্রিকার কাগজে এবং ভার্চুয়াল জগতে। তার মধ্যে করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে চোখে পড়ছে বেশি। কিছুদিন হলো উলামায়ে কেরাম এবং আমাদের পরিচিত সাথী সঙ্গীদের বিজ্ঞাপনও খুব চোখে পড়ছে।
এমনই একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম কিছুদিন আগে। বিজ্ঞাপনদাতা আমার খুবই পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। সেই সূত্রে বাজারি বিজ্ঞাপনের সাথে সাথে ব্যক্তিগতভাবেও বিজ্ঞাপন পেলাম। সালামের পর তিনি নিজেই জানালেন, এই গ্রুপটি আমার। এখানে আমি এই এই পণ্য বিক্রি করি। আমি তো অবাক এবং পরবর্তীতে মুগ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, আমি আপনার পণ্যের গ্রাহক হবো ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু পণ্য গ্রহণের আবেদন (অর্ডার) করার আগেই একদিন ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অনেকদিন পর দেখা। উষ্ণ সাক্ষাৎপর্ব হলো। বললাম, আপনার পণ্য নেওয়ার মাধ্যমেই জীবনের প্রথম অনলাইন কেনাকাটার উদ্বোধন করব নিয়ত করেছি। তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি তো কতদিন ধরেই আপনার অর্ডারের অপেক্ষা করছি।
কয়েকদিন পর ফোনের মাধ্যমে পণ্য চেয়ে আবেদন করলাম। সকালে আবেদন, দুপুরে পণ্য হাজির। এবং ঘনিষ্ট সেই মানুষটিও। খুব পীড়াপীড়ি করলাম বাসায় নিতে। বলল, আরেকদিন। আজ অনেকগুলো ‘ডেলিভারি’ আছে। ডেলিভারি শব্দটি আমি শুধু ডাক্তার ও হাসপাতালের সঙ্গেই শুনে অভ্যস্ত। তার মুখে শুনে আরেকবার এই ‘ভালো মানুষটি’র দিকে তাকালাম।
অনেক পীড়াপীড়ির পরও বাসায় না নিতে পেরে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা হলো। কয়েক মিনিটে তার চিন্তা ও পরিকল্পনার কিছু কথা শুনে আমি মুগ্ধ। তার পরিকল্পনার একটা বাক্য তো তাদের বিজ্ঞাপনেও থাকে। ‘বিক্রিত পণ্য ফেরত নেয়া হয়।’ ইসলামের কত বড় শিক্ষা এটা। হাদীস শরীফে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ أَقَالَ مُسْلِمًا، أَقَالَهُ اللَّهُ عَثْرَتَهُ
যে বিক্রয়কারী কোনো মুসলমানের ক্রয়কৃত বস্তু ফেরত নিবে, আল্লাহ তাআলা তার পদস্খলন-গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৪৬০
কোনো পণ্য কেনার পর সেটি ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মানুষের হতে পারে। পণ্যটির প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়া, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ভুল বুঝে কেনা কিংবা কেনাকাটায় ঠকা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সেটি ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন কখনো হয়। যদিও সে প্রয়োজন সব সময় হয় না এবং সবার হয় না। কিন্তু ইসলাম সেই হঠাৎ প্রয়োজনকেও কী সুন্দরভাবে বিধিত করেছে। বাধ্য করেনি, উৎসাহিত করেছে। এই নববী উৎসাহকে গুরুত্ব দিয়ে যারা বিক্রিত পণ্য ফেরত নেয়, তাদের গ্রাহক যেমন বেশি হয় তেমনি ব্যবসায় বরকতও হয় অনেক বেশি। দুনিয়ার কত দোকানে আমরা দেখেছি বড় করে লেখা, ‘বিক্রিত পণ্য ফেরত নেওয়া হয় না।’ কিন্তু একজন আলেম বিক্রেতার চিন্তা সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, সে চিন্তা করে নববী চিন্তাকে অবলম্বন করে। তার সকল কার্যক্রম ও কার্য পরিকল্পনা হয় দ্বীন ও শরীয়তকে সামনে রেখে। এতে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বরকত যেমন লাভ করে, তেমনি ক্রেতা সাধারণও উপকৃত হয়, স্বচ্ছন্দে কেনাকাটা করতে পারে। এভাবে সুষ্ঠু সুন্দর ও সৌহার্দ্যময় দ্বীনী পরিবেশ গড়ে উঠে।
তারা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ আমি তাদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন হযরাতুল উস্তায আদীব হুযূর হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের একটি কথা খুব মনে পড়ল। কথাটি পড়েছি মাদরাসাতুল মাদীনার এক তালিবুল ইলম ভাই মাওলানা হুযাইফা কাসেমীর লেখায়। আদীব হুযূর নাকি বলেছেন, “ঢাকা শহরে যদি মোটামুটি ১০০ জন মাদরাসা পড়ুয়া এবং সুন্নতী লেবাসধারী বাসচালক থাকত, তাহলে এই পরিবহন চালকদের মাঝে বাস্তবিক অর্থেই চারিত্রিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা তো নিজেদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্যও (অর্থাৎ নিজে তো অন্যকোনো কাজ করতে চাই-ই না, অন্যকেউ করলেও তাকে বাধা দেই বা অনুৎসাহিত করি)।”
ভাবলাম, বাস্তবেই তো দ্বীনের বুঝ-জ্ঞান ও দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণকারী লোকেরা যদি সমাজের সকল ক্ষেত্রে কাজ করে তাহলে অন্যদের চেয়ে কিছুটা হলেও ভালো আশা করা যায়। কারণ দ্বীনদার একজন মানুষ আল্লাহকে যতটা ভয় পায়, যতটা স্মরণ করে, যতটা হালাল হারামের চিন্তা করে, অন্যরা সেটা করে না। ফলে তাদের কাজ কর্মে অন্যদের চেয়ে সততা স্বচ্ছতা একটু হলেও বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পূর্ণমাত্রায় সততা স্বচ্ছতা থাকারও আশা করা যায়। তাহলে এভাবে যত সহজে আমাদের মাঝে পরিবর্তন আনা সম্ভব অন্য কোনোভাবে সেটা তত সহজ নয়। এসব ভেবে আনমনে তাদের জন্য খুব দুআ করলাম। সামজের সকল দুর্নীতি, দুরাচার, অসততা ও অমানবিকতা দূর হওয়ার দুআ করলাম। সুষ্ঠু সুন্দর ও পবিত্র পরিবেশের একটি সমাজ লাভের তীব্র তামান্না হৃদয়ে জেগে উঠল।
তাদের প্রতিষ্ঠনটির নামও মাশাআল্লাহ সুন্দর। ‘স্বচ্ছ পণ্য’। আল্লাহ তাআলা এ নামের উসিলায় তাদের মাঝে এবং আমাদের সবার মাঝেই সততা স্বচ্ছতা দান করুন। যিন্দেগীর ময়দানে আমাদের সবাইকে কামিয়াব করুন। দুনিয়া আখিরাতের চির সফলতা দান করুন। আমীন।
![](https://www.islamtime24.com/wp-content/uploads/2021/03/20210308_200803-scaled.jpg)