ইচ্ছা এবং দোআ

হাসান নেসার ।।

চেষ্টাবিহীন ইচ্ছা হলো আত্মাছাড়া দেহের ন্যায়। যে দেহকে মাটিচাপা দিতে মানুষ সবসময় তাড়াহুড়ো করে। ইচ্ছা সম্পর্কে ইংরেজি একটি প্রবাদকে ‘শেষকথা’ মনে করতে পারেন। যার ফ্রি স্টাইল অনুবাদ করলে অর্থ কিছুটা এমন দাঁড়াবে- ‘যদি ইচ্ছেগুলো ঘোড়া হয়ে যেত তবে প্রত্যেকেই শাহসওয়ার হত।’

বাকি রইল দোআ। তো আমি কিছুদিন পূর্বে এধরনের একটি কলামে আরয করেছিলাম যে, দোআ ভাগ্যকেও পাল্টে দিতে পারে। ৭ জুলাই ২০২০ তারিখে লিখেছিলাম, মূল্যবান এবং স্পর্শকাতর উৎপাদিত পণ্যের প্যাকেটের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে-  “FRAGILE, HANDLE WITH CARE” (স্পর্শকাতর, সযত্নে নাড়াচাড়া করুন।)

আমার সাধ্য থাকলে প্রতিটি ব্যক্তির মাথায় একথাটা লিখে দেই, “LIFE IS FRAGILE, HANDLE WITH PRAYER”     ( জীবন বড় সংবেদনশীল। দোআর সঙ্গে ব্যবহার করুন।) অর্থাৎ দোআ আমার ঈমানের অংশ। বহু বছর ধরে আমি শোয়ার আগে অবশ্যই দোআ করে নেই।

মা-বাবার জন্যই নয় শুধু, সকল মরহুম বন্ধু-স্বজনের জন্যও মাগফিরাতের দোআর পর পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং না-জানি কার কার জন্য সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার দোআ। এভাবে যত আপনজন পরলোকগমন করছে, আমার দোআর পরিধি তত বিস্তৃত হচ্ছে। কিছুদিন আগে আমার এক নিকটাত্মীয়কে বলছিলাম, যদি কয়েক বছর আরো বেঁচে যাই, তাহলে দোআর এ ধারা মধ্যরাত পরযন্ত দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, মরহুমদের লিস্ট ক্রমে লম্বা হচ্ছে।

শেষ দুটি নাম মওলবী সাঈদ আযহার এবং ডক্টর মুগীসুদ্দীনের। আমি তোমাদের দুজনকে ভুলে যাব যদি আমার ডানহাত তার লেখালেখি ভুলে যায়। আবার অনুরোধ করার পূর্বেই আমি পুনরায় আরয করে দেই, দোআ আমার ঈমানের অংশ। কিন্তু যেমনিভাবে ইচ্ছে পূরণের জন্যও চেষ্টা, মেহনত এবং পরিশ্রম অত্যাবশ্যক, তদ্রুপ দোআর জন্যও মেরিট বা ‘যোগ্য হওয়া’ প্রয়োজন। কিন্তু মেরিট কী?

শিআবে আবি তালিবের প্রাণান্তকর যন্ত্রণা থেকে নিয়ে তায়েফের সেই পাষাণ পাথর পর্যন্ত, হিজরতের দুঃখ-কষ্ট থেকে নিয়ে বদরে প্রবাহিত পবিত্র রক্ত পর্যন্ত, উহুদের শহীদান এবং আহতদের থেকে নিয়ে খন্দকের যুদ্ধের রণাঙ্গন পর্যন্ত সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতাই হল সেই ‘মেরিট’। যা অনেক মানুষ খুবই সহজে এবং অবলীলায় ভুলে যায়। আর তাদের মধ্যে অনেকে বিস্মিত হয়ে ভাবতে থাকে, আমাদের দোআ কবুল কেন হচ্ছে না?

যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, নিজের প্রিয়জনদেরকে আবেগাপ্লুত কন্ঠে কেঁদে আকুল হতে দেখেছি যে, কাশ্মির থেকে ফিলিস্তিন সর্বত্র শান্তি আসুক! কিন্তু তার ফল?

একবার একটি আশ্চর্য ধরনের হিসাব করেছিলাম। বরং আমার সঙ্গে থাকা টীমকে দিয়ে করিয়েছি। হিসাবটির সারনির্যাস হলো, মনে করুন গোটা পৃথিবীতে এখন মুসলমানদের আনুমানিক সংখ্যা কত? তাদের মধ্যে এক চতুর্থাংশও যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযী হয়, তাহলে একদিনের নামায এবং দোআর আনুমানিক সংখ্যা কত হবে? একদিনে কৃত দোআসমূহকে বছরের ৩৬৫ দিন দ্বারা গুণ করা করলে, আর তারপর এর সর্বমোট সংখ্যাকে শুধু একশ বছর দিয়ে আবার গুণ করার পর যে মোট ফলাফলটি আসবে সেটি নিয়ে ভাবুন।

এই সর্বমোট সংখ্যা দেখে একে তো কম্পিউটারই ফেটে যাবে অথবা মাফ চেয়ে নেবে। কিন্তু যদি কম্পিউটারটি একটু বেশিই তেজি হয়, তাহলে হিসাবকারীর নিজের মাথাটা অবশ্যই ফেটে যাবে! নয়তো বিকল হয়ে পড়বে। এ অনুশীলন ও কসরত থেকে আর কিছু না হোক, মেরিট  (যোগ্য হওয়া)-এর অর্থ অবশ্যই বুঝে এসে যাবে।

একবার একজন অতিশয় মানী লোকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মহাশয়! আমাকে এটা বলুন, যদি আমি কোন অমুসলিম বরং নাস্তিকের জমিজমা-সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নেই, এরপর মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, বিচারকও ঘটনাক্রমে সৎ এবং নীতিবান হয়, ভুক্তভোগী কেঁদে কেঁদে ফিরতে থাকে, আর আমি জায়নামায বিছিয়ে আমার পক্ষে রায়ের জন্য দোআ করতে থাকি, তাহলে রায় কার পক্ষে আসবে?

তিনি উত্তর দেননি। উত্তরটি হলো, পালনকর্তা খোদা- যিনি রহমান ও রহীম, তার একটি নাম ‘আলমুকসিত’ও আছে। অর্থাৎ ন্যায়বিচারক। অর্থাৎ যার প্রতিটি কাজ ইনসাফ ও ভারসাম্যের চূড়ান্ত। তিনি যদি ‘আলআফু’ তথা ক্ষমাশীল হয়ে থাকেন, তাহলে কিভাবে ভুলে যাবেন তার আরেক নাম। তিনি তো ‘আলমুনতাকিম’ও। অন্যায়কারীদের শাস্তিদাতাও। আর ক্ষমা! কীভাবে ক্ষমা হবে? ক্ষমারও তো একটা নিয়ম-নীতি এবং শর্ত আছে! ‘আর কখনো করব না’। কিন্তু অন্যায়-অপরাধও করতে থাকা, ক্ষমাও চাইতে থাকা, আবার দোআ কবুলের অপেক্ষাতেও থাকা?!

আমরা গম উৎপাদন না করেই দুটি নয়, অগণিত রুটি চাইছি। তিনি ‘আত-তাওয়াব’। নিঃসন্দেহে বান্দার তওবা কবুলকারী। কিন্তু তওবা ভঙ্গ করলে তিনি ‘আলখবীর’-সম্যক অবগতও তো! তিনি ‘আলআদল’ । পরিপূর্ণ ন্যায়বিচারকারী। এবং ‘আলহাকাম’ও। যিনি ইনসাফ করেন এবং সকল হকদারকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। এবং যিনি ‘আলবাসীর’ (THE ALL SEEING) । প্রতিটি বস্তু দেখছেন। তবে কি আমাদের সত্ত্বা আমাদের ভেতরকার বাস্তবতা সম্পর্কে বেখবর?

তিনি ‘আসসামী’। সবার সবকিছু শুনতে পান। (THE ALL HEARING) তেমনি তিনি ‘আলমুযিল’ও। লাঞ্ছনা দানকারী। তাঁর পবিত্র নামসমূহের মধ্যে এটিও একটি। অর্থাৎ যিনি অহংকারী, নাফরমান ও অত্যাচারীদেরকে লাঞ্ছিত এবং অপদস্থ করে দেন। আর যারা  মেরিটের (যোগ্যতা) কদর করে, তাদের জন্য তিনি ‘আলমুইয’। (THE HONORER)। সম্মান, প্রতিপত্তি ও সমাদর দানকারী।

সারকথা এবং শেষকথা সেটাই যে, ইচ্ছেপূরণ করতে যেমন সর্বোচ্চ চেষ্টা শর্ত, তেমনি দোআ কবুল হওয়ার জন্যও ‘মেরিট’ অত্যন্ত জরুরি। তা না হয়… এক শতাব্দির বঞ্চনা বহু শতাব্দি গড়াতে থাকবে।

ডেইলি জং থেকে ভাষান্তর: সাইফ নূর

পূর্ববর্তি সংবাদজিজ্ঞাসাবাদের সময় র‍্যাব কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন সাহেদ!
পরবর্তি সংবাদচামড়ার ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের দাবিতে জাতীয় ওলামা পরিষদের সংবাদ সম্মেলন