পাঠাগারের শহর আন্দালুস

আনওয়ার মাহমুদ যানাতি।।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, ধর্মীয় কাজে চিরস্থায়ীভাবে নিজের মালিকানাধীন সম্পদ উৎসর্গ করাকে বলা হয় ‘ওয়াকফ’। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস বলে, যুগে যুগে ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির পেছনে প্রচলিত ‘ওয়াকফ’ পদ্ধতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সমাজ-জীবনের বেশিরভাগ শাখায় এই ওয়াকফের প্রভাব সুবিস্তৃত। ওয়াকফের যত শাখা-প্রশাখা আছে, তার মধ্যে চমৎকার গুরুত্বপূর্ণ একটি  শাখা হলো ‘মাকতাবা’ বা পাঠাগার ওয়াকফ করা। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও পাঠপ্রেমীদের জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্যোগ সমাজের নিরক্ষরতা দূর ও সাংস্কৃতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বড় সহায়ক। পাশাপাশি এই পদক্ষেপ ইলম ও জ্ঞানের প্রতি আমাদের পরম্পরাগত ভালবাসার নিদর্শন। ইলমের প্রচার- প্রসারের একটি বড় মাধ্যম।

আজকের যে স্পেন, আমাদের অতীতের আন্দালুস, সেখানে একসময় ওয়াকফকৃত মাকতাবা ও পাঠাগার ছেয়ে গিয়েছিল। ইলমের অন্বেষণে আন্দালুসবাসীর গভীর আগ্রহ ছিল। স্বপ্রণোদিত হয়ে মানুষ পাঠে মনোনিবেশ করত। যে বিষয়ে পাঠ শুরু করত, তার একেবারে মূলে পৌঁছার চেষ্টা করত। এ কারণে সেখানকার ওলামা-সমাজ নিজ নিজ বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

ইলম অর্জনের পথে লোকজন তাদের ধনভাণ্ডার উজাড় করে দিত। কোন বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে পারা সে সমাজে ছিল ব্যাপক সম্মানের বিষয়। জগত-জীবনের অন্য কিছুর চেয়ে জ্ঞান- সাধনা তাদের কাছে ছিল অধিক প্রিয়। সীমাবদ্ধ জ্ঞানচর্চায় তাদের তৃপ্তি ছিল না। হাতে গোনা দুয়েকটি বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেই তারা থেমে পড়ত না।

আন্দালুসের ইতিহাসে এমন অনেক আলেমের পরিচয় মেলে, যারা একই সঙ্গে হাদিস, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে জগৎজোড়া খ্যাতি ছড়িয়েছেন। আন্দালুসে ওয়াকফকৃত পাঠাগারের সংখ্যা ছিল অনেক এবং তা  ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর প্রমাণ মেলে বিখ্যাত আলেম আবু হাইয়ান মুহাম্মদ বিন ইউসুফ আল আন্দালুসি রহ. এর কথায়। যারা কিতাব কিনে পড়ে, তাদের তিনি কটাক্ষ করে বলতেন, ‘সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপন করার জন্য আল্লাহ তোমাকে একটু আকল দান করুন। কিতাব কেনা আবার কেমন কথা! আমার যে কিতাব প্রয়োজন হয়, তা তো আমি উন্মুক্ত পাঠাগার থেকে নিয়ে পড়ি এবং আমার প্রয়োজন সেরে ফেলি।’

আন্দালুসে মুসলমানদের বসতি যতদিন ছিল, ততদিন প্রতিটি মসজিদসংলগ্ন পাঠাগারের ব্যবস্থা ছিল এবং সেসব পাঠাগারে ইলমি ও সাংস্কৃতিক- সব ধরনের কিতাবের মজুদ থাকত। আলেম-সমাজ তাদের নিজস্ব কিতাবসমূহ সংরক্ষণ করার জন্য, পাশাপাশি ছাত্র ও সাধারণ পাঠকদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সেগুলো মসজিদকেন্দ্রিক পাঠাগারগুলোতে রেখে দিতেন। যাদের ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল না, তারা সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করত। এই মসজিদভিত্তিক পাঠাগারগুলোকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে সমস্ত আন্দালুসে ছোট-বড় নানা পাঠাগার গড়ে ওঠে।

আন্দালুসের একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ হচ্ছে মসজিদে তুলাইতিলাহ। সেখানকার পাঠাগারের প্রসিদ্ধি ছিল খুব। সেখানে নিয়মিত পাঠের আসর বসত এবং বড় বড় আলেম সেখানে দরস দিতেন। সেই
দরসগুলো এত জ্ঞানসমৃদ্ধ ও মূল্যবান ছিল যে, ইংল্যান্ড,স্কটল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে মুসলমান তালিবে ইলমরা; এমনকি খ্রিষ্টান ছাত্ররাও সেখানে সমবেত হতো। ‘সংস্কৃতির কেন্দ্র’ হিসেবে দক্ষিণ ইউরোপীয় খৃষ্টীয় দেশগুলোর প্রান্তে প্রান্তে এই মাকতাবার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। উমাইয়া খলিফা মুনতাসির বিল্লাহ তিনশ’ পঞ্চাশ হিজরীতে কুরতুবা জামে মসজিদে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠাগারের দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ কর্মী নিয়োগ দেন। লিপিকারদের এনে তাদের হাতে বিরাট সংখ্যক কিতাবাদি প্রস্তুত করিয়ে নেন। পরবর্তীতে এই মাকতাবা আলেম-ওলামা ও তালিবে ইলমদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। শুধু আন্দালুসই নয় বরং ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে জ্ঞানপিপাসুরা সেখানে আসতে থাকে।

মসজিদের যাহারা ও মসজিদে মালিকার পাঠাগারগুলোরও বিশেষ খ্যাতি ছিল। সেখানকার ওলামায়ে কেরাম তাদের ব্যক্তিগত কিতাব পাঠাগারে জমা করে বিরাট সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন।

মুহাম্মাদ বিন লুব আল কিনানি নামক একজন আলেম প্রথমে তার ব্যক্তিগত পাঠাগার ও মৃত্যুর আগে তার ঘরবাড়িসহ সবকিছুই মসজিদে মালিকার মাকতাবার জন্য ওয়াকফ করে দেন। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের প্রতি এই হলো আন্দালুসবাসীর ভালোবাসার নমুনা!

পাঠাগার ও পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা থাকায় মসজিদগুলোতে মাদরাসার চিত্র ফুটে উঠত। সেখানে চর্চা হতো ফিকহ ও যুক্তিশাস্ত্রের কিতাবাদি। সাহিত্য ও দর্শনের পাঠও চলত। প্রাচ্যবিদ সিগ্রিড হুঙ্কে তার ‘শামসুল আরাব তাসতা’য়ু আলাল গর্ব’ কিতাবে লিখেছেন, ‘তখনকার শাসকগোষ্ঠী প্রতিটি এলাকায়একটি করে কিতাবঘর নির্মাণ করে সেগুলো অসংখ্য কিতাবাদি দিয়ে সাজিয়ে তুলতেন এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতেন। এভাবে হাজার হাজার মাকতাবা সেখানে গড়ে উঠেছিল।’ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের ধনী ও দানশীল শ্রেণীরও এই মাকতাবা প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ধরনের অংশগ্রহণ থাকত।তখনকার যারা লেখক-শ্রেণী, তাদের লেখা তৈরীর জন্য আন্দালুসের বাইরে দূর-দূরান্তে সফর করা লাগত না। খুব সহজেই তারা মাকতাবাগুলো থেকে উপকৃত হতে পারতেন। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারতেন। চারদিকে মাকতাবার ছড়াছড়ি লেখার ময়দানেও সাড়া ফেলেছিল। আলেম-ওলামাদের বড় একটি অংশ লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
মাকতাবার সুবাদে আন্দালুসবাসীর মধ্যে ব্যাপক পাঠচর্চার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল এবং এর সুফল হিসেবে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল শুদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতি-বোধ। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ নিরক্ষরতার আঁধার থেকে বেরিয়ে দীনি ও জাগতিক বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

মোটকথা-আন্দালুসের যে ইসলামী সাংস্কৃতিক উত্থান, তার পেছনে অনেকাংশেই ভূমিকা ছিল এই পাঠাগারসমূহের। জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে আলোর দিশা পাওয়ার জন্য পৃথিবীবাসীকে আল্লাহ যে পন্থা বলে দিয়েছেন, তা হলো ‘পড়ো’। কাজেই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আর দীনি গ্রন্থাগার নির্মাণ ও সমাজের সবাইকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ, সবার পাঠাভ্যাস ও দীনি চেতনা তৈরিতে ভালো ফলদায়ক হতে পারে। আন্দালুসের পাঠাগার-সংক্রান্ত ইতিহাস আমাদের এ কথাই বলে।

ভাষান্তর: জহুরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ,ভাকুর্তা, সাভার।

পূর্ববর্তি সংবাদকালীগঞ্জে হিন্দু জুয়েলারীর সৎকারে কেউ এগিয়ে আসেনি ইমাম পরিষদ ছাড়া
পরবর্তি সংবাদএমপি পাপুলের কারাবাসের মেয়াদ বাড়ল