‘লট বক্স’: যে নেশার চক্রে ভিডিও গেমসে সব সঞ্চয় উড়িয়ে দিচ্ছে হাজারো কিশোর-তরুণ

মুশফিক ইলাহী ।।

সাম্প্রতিক সময়ে ভার্চুয়াল জগতের এক ভয়াবহ মরণ নেশার নাম ‘অনলাইন ভিডিও গেমস’। উঠতি বয়সের কিশোর তরুণদেরকে মহামারির মতো গ্রাস করে নিচ্ছে এই গেমসগুলো। প্রতিনিয়তই গেমসগুলোকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর সব দূর্ঘটনার তথ্য আসছে মিডিয়াতে।

‘পাব জি’ নামক গেমসের কারণে আত্মহত্যা করলো যুবক, গেমস খেলতে বাধা দেয়ায় বাবাকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করলো সন্তান”- ইত্যাদি সংবাদ এখন প্রায়ই পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে শিরোনাম হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে অনলাইন গেমসগুলোর সঙ্গে সমানতালে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘লট বক্স’ নামের আরেক জালিয়াতি। অনেকটা ‘স্লট মেশিন’ জুয়া স্টাইলের এই ভার্চুয়াল আইটেমটি কিশোর-তরুণদের গেমসের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিভাবকদের অজান্তেই সন্তানরা তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ শুধুমাত্র গেমসের পেছনেই উড়িয়ে দিচ্ছে।

কী এই ‘লট বক্স’?
লট বক্স হল একটি ভার্চুয়াল আইটেম বা অনলাইন ভিত্তিক প্লাটফর্ম। যার ব্যবহারকারীরা বাস্তব জগতের আসল অর্থ দিয়ে (অনলাইন গেমসের কাল্পনিক অর্থ দিয়ে নয়।) বিভিন্ন গেমস কিনতে পারে। অথবা নিজেদের ইচ্ছেমতো এলোমেলোভাবে গেমসের বিভিন্ন অপশন পরিবর্তন করতে পারে। যেমন কার বা বাইক রেসিং গেমসগুলোতে নিজেদের ইচ্ছেমতোঅধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আপডেট কার অথবা বাইক কিনতে পারে। ফাইটিং গেমসগুলোতে অধিক শক্তিশালী যোদ্ধা, নতুন নতুন অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি সরঞ্জামাদি কিনতে পারে।

তবে এক্ষেত্রে ফিফার অনলাইন ভিত্তিক ফুটবল গেমসগুলোতে লট বক্সের জালিয়াতি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সেখানে লট বক্সের মাধ্যমে অর্থ দিয়ে নিজেদের পছন্দসই খেলোয়ারদেরকে পাওয়ার জন্য প্লেয়ার্স কার্ড প্যাক কিনে টিম গঠন করতে হয়। বাস্তব জগতের ফুটবল তারকাদের মতো অনলাইনেও বিভিন্ন ফুটবল তারকা যেমন, লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সার্জিও র‌্যামোসদের মতো বিশ্বখ্যাত তারকাদের ক্রয় করে টিম গঠন করা যায়। প্রতিটি প্লেয়ার্স কার্ড প্যাকে অনির্দিষ্টভাবে কয়েকজন খেলোয়ার থাকে। যাদের মাঝে কাঙ্খিত খেলোয়ার থাকতেও পারে; আবার নাও থাকতে পারে। কাঙ্খিত খেলোয়ারদের পাওয়ার জন্য অনিবার্যভাবে বারবার প্লেয়ার্সপ্যাক কিনতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই প্লেয়ার্স প্যাক কিনতে কিনতে ফতুর হয়ে যাওয়ার পরও কাঙ্খিত খেলোয়ারের দেখা মেলে না। প্লেয়ার্স প্যাক ক্রয়ের এই প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্ট একটি জুয়ার প্রক্রিয়া। যদিও ফিফার গেমস কর্তৃপক্ষ বরাবর তা অস্বীকার করে আসছে। এভাবে যে যত বেশি অর্থ ব্যয় করে প্লেয়ার্স প্যাক কিনতে পারে তার টিম ততই শক্তিশালী হয়। কিন্তু এ-সবই হয় বাস্তব জগতের প্রকৃত অর্থ দিয়ে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বে লট বক্সের বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই লট বক্সকে সরাসরি জুয়া হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম বেলজিয়ামে লট বক্স কেন্দ্রিক ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে আরো অনেক দেশেই লট বক্সের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করে দেয়া হয়।

বিবিসির কয়েকটি প্রতিবেদনে লট বক্সেগুলোর জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের অধিবাসী সুসি ব্রেক বলছেন, “আমার একটি বাইশ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে রয়েছে। যে আমার অজান্তে মাত্র একটি গেমসের পেছনেই ৩,১৬০ ডলার ব্যয় করেছে।” হ্যাম্পশায়ারের আরেক অধিবাসী মিস্টার কার্টার বলেন, “আমার বাচ্চারা ফিফার গেমস খেলতে খেলতে আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করে ফেলেছে। তারপরো তারা তাদের প্রিয় তারকা লিওনেল মেসিকে পায়নি।” ইংল্যান্ডের পশ্চিম সাসেক্সের অধিবাসী আনন বলছেন, “আমার ছেলেটির বয়স মাত্র বারো। কিন্তু সে এই বয়সেই ক্লাশ অফ ক্লান্স গেমসটিতে ৭০০ ডলার ব্যয় করে ফেলেছে।”

শুধু তাই নয়; অসংখ্য কিশোর-তরুণ বাবা-মার অজ্ঞাতসারে তাদের সারা জীবনের সঞ্চয়কৃত অর্থ-সম্পত্তি গেমসেই লুটিয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সর্বস্ব হারিয়ে তারা এখন পথের ফকির হয়ে বসেছে!

সেইসব হতভাগ্য কিশোর-তরুণদের একজন জোনাথন পেনিকোট। যে লট বক্সের জালে আটকে গিয়ে গেমসের পেছনে সারা জীবনের সঞ্চয় লুটিয়ে দিয়ে পথে বসেছে। জোনাথন পেনিকোটও তার সমবয়সী অন্যান্য কিশোরদের মতো অনলাইনে ফিফা ফুটবল খেলতে পছন্দ করতো। যেখানে সে খেলোয়ারদের প্যাক কিনে কিনে নিজের টিম গঠন করেছিল। জোনাথনের মা যখন কান্সারে আক্রান্ত হন, তখনো সে প্লেয়ার্স প্যাক কেনার আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। মায়ের অসুস্থতার কঠিন পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য ভিডিও গেমসকেই অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। গেমসে এতো বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে, প্রতিদিন নতুন নতুন খেলোয়ারদের প্যাক কেনা ব্যতিত সে থাকতেই পারতো না।

নিজের জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জোনাথন বলেন, আমি শৈশব থেকেই ভিডিও গেমস পছন্দ করতাম। আমার মনে আছে যে, সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলোতে আমি খুব ভোরে উঠতাম এবং খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতাম। তারপর ফিফা ফাইভ গেম খেলায় মত্ত হয়ে যেতাম। আমি গেমসের সাউন্ড অফ করে দিতাম যাতে আমার বাবা-মা বুঝতে না পারেন। আমার বয়স এখন ২১ বছর। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব তারাই, যারা অনলাইনে আমার বন্ধু হয়েছিল।

লট বাক্সের ফাঁদে
আমার ভালোভাবে স্মরণ আছে, যখন আমি প্রথমবার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করি যে, নিজের পকেট থেকে আমি কোন প্লেয়ার্সকার্ড প্যাক কিনতে পারি কি না ? জবাবে আমার বাবা বলেছিলেন, ‘না, তুমি তা কিনতে পারো না । কারণ এটি একটি জুয়া। তখন আমি বড়ই নিরাশ হয়েছিলাম। কিন্তু অবশেষে তিনি আমার পীড়াপীড়ির কাছে হার মেনেছিলেন।

সেই সময় আমার কাছে বাবা-মার এই কথা খুব আশ্চর্য লাগতো যে, কার্ড প্যাক কেনা হচ্ছে এক প্রকার জুয়া। প্রতিবার খেলোয়ারদের প্যাক কেনার সময় আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম এইবারের প্যাকের মাঝে আমার প্রিয় খেলোয়াররা থাকবেই থাকবে। এভাবে কার্ড প্যাক কিনতে থাকতাম। অনেক সময় আমার ভাগ্য ভালো হতো। আমার কাঙ্খিত কোন খেলোয়ার পেয়ে যেতাম। তখন আরো নেশা চেপে বসতো। যদি আমি আরো পনেরো পাউন্ড ব্যয় করতাম তাহলে…….

এভাবে দীর্ঘ চার বছর কেটে গেলো। খেলোয়ারদের ওপর আমার ব্যয়ও লাগামহীন বাড়তে থাকলো। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে কার্ড প্যাক ক্রয়ের বিষয়টি গোপন করতে লাগলাম। আমি বাজার ভাউচার কিনে কিনে আমার কক্ষে লুকিয়ে রাখতাম যাতে আমার মা-বাবা জানতে না পারেন। সেই সময়গুলোতে ভিডিও গেমস ছাড়া আমার আর কোন ব্যয়ের খাত ছিল না।
আমি প্রতিবারই ভাবতাম, এবার তো অবশ্যই আমার ভাগ্য খুলে যাবে! আমার বয়স যখন সতেরো পূর্ণ হয় তখন আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি। আমার হাতে ডেবিট কার্ড চলে আসে এবং গেমসের পেছনে অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়। তখন আর ভাউচার কেনার ঝামেলাও ছিল না। কেবলমাত্র একটি বাটনে ক্লিক করেই খেলোয়ার ক্রয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

২০১৭ সালে এসে আকস্মিক আমার জীবনের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সে বছর আমি লিভসে ছিলাম এবং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু সেপ্টেম্বরের দিকে যখন আমার মা কান্সারে আক্রান্ত হন; তখন আমার কাছে পুরো পৃথিবীটাই বদলে যায়। সবকিছু যেন থমকে দাঁড়ায়। আমি অস্থির হয়ে সেই দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকি, যেদিন আমার মা সুস্থ হয়ে যাবেন, আমার পরীক্ষাগুলো শেষ হবে। সবকিছু আবার আগের মতো স্বভাবিক হয়ে যাবে।

জোনাথন বলেন, আমি এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে থাকি। অবশেষে প্লেয়ার্স প্যাকের নেশাই আমাকে পরিস্থিতি থেকে পালানোর পথ দেখায়। ভিডিও গেমসের নেশায় আমি আরো গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি! তারপর একদিন সব সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে গেলো। আমার বাবা-মা এবং দাদা-দাদি আমার ভবিষ্যতের জন্যে অর্থ সঞ্চয় করছিলেন। আমি এর যৌক্তিকতা বুঝতে চাইতাম না। আমি বলতাম, আমার এখন অর্থের প্রয়োজন। ভবিষ্যত তার আপন গতিতে চলবে।

আমি প্লেয়ার্স প্যাক কেনার জন্য কখনো ৩০ পাউন্ড, কখনো ৪০ পাউন্ড ব্যয় করতাম। অবশেষে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যখন আমার লেনদেন আটকে দেয়া শুরু করলো তখন আমি এক রাতে তিনবার চারবার করে ৮০ পাউন্ড খরচ ফেলতাম। পরীক্ষার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও আমি ইউটিউবে অন্যদের প্লেয়ার্স প্যাক খেলা দেখতাম। এদিকে আমার মা-বাবা ভাবতেন যে আমি আমার কক্ষে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি! অবশেষে সেই দিন এসে যায়, যেদিন আমার সব টাকা-পয়সা নিঃশেষ হয়ে যায়।
আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদি আমাকে তিন হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন। যার পুরোটাই আমি গেমসের পেছনে উড়িয়ে দিয়েছি।
এসব যা কিছু ঘটেছে তার পুরো দায়ভার আমার ওপরই বর্তায়। কারণ অর্থগুলো ব্যয় করা আমারই সিদ্ধান্ত ছিল। আমি আমার ভুল স্বীকার করি। পরবর্তীতে বাবা-মা যখন আমার ব্যাংক স্টেটম্যান্ট দেখেন, তখন তারা হতবাক হয়ে যান।

রঙ্গিন সুখের নেশা
যদি আমি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, তবে সর্বপ্রথম আমার মনে যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে, যখন আমি এসবে ডুবে ছিলাম তখন আমার পরিবারের তার কিছুই জানতো না। আমাদের ঘরে গেমসের ব্যাপারে যথেষ্ঠ নিয়ম-কানুন ছিল এবং আমার মা-বাবা তা কার্যকরও করেছিলেন। তাদের আমি বারবার বলতাম যে, আমি গেমসে আসক্ত নই।

এখনো আমি জোর দিয়ে বলছি, আমি মূলত গেমসে আসক্ত ছিলাম না। তবে কার্ড প্যাক কেনায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। যখন ২০১২ সালে আমার বাবা বলেছিলেন যে, এটি একটি জুয়া খেলা, তখন আমি তার কথায় আশ্চর্য হলেও এখন আমি বাবার সাথে সম্পূর্ণ একমত। কোন সন্দেহ নেই, এই গেম প্যাক বা লট বাক্সগুলো হচ্ছে জুয়ার একটি প্রকার। যার মধ্যে কোন দামি খেলোয়ার থাকার সম্ভবনাও রয়েছে আবার না থাকার আশংকাও রয়েছে। হাউস অফ লর্ডসের জুয়া কমিটি যেহেতু লট বক্সগুলোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রের চেষ্টা করছে। তাই আমিও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমার মতো পরিস্থিতির স্বীকার হাজারো কিশোর-তরুণদের সাহায্য করতে চাই।

ফিফা গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ঊ.অ.এর প্রতিক্রিয়া
ফিফা গেমস নির্মাতা ই. এ. স্পোর্টস প্লেয়ার্স প্যাকের জুয়া হওয়ার বিষয়টি বরাবরের মতো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ফিফার গেমসটি কোনরকম অর্থ ব্যয় না করেও খেলা যায়। খেলোয়ার ক্রয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ যার যার ইচ্ছাকৃত বিষয়। বিষয়টির জন্য সরাসরি ফিফা কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া মেলেনি।

সূত্র:বিবিসি

পূর্ববর্তি সংবাদশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কী ভাবছে মন্ত্রণালয়
পরবর্তি সংবাদবাংলায় ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল