আযানের ধ্বনি শুনিতে ব্যাকুল

ড. সফদর মাহমুদ ।।

এ ধারণাটি আমার আনুমানিক চার দশক পূর্বে হয়েছে যে, সমাজে জীবন যাপনের পর্যায়গুলো অতিক্রম করার সময় কিছু কিছু অভ্যাস, রুটিন এবং বৈশিষ্ট্য মানুষের সত্ত্বার অংশ হয়ে যায়। যখন এ জিনিসগুলোর কোনটি অনুপস্থিত থাকে, তখন মানুষ তার শূন্যতা তীব্রভাবে অনুভব করে।

অনেকদিন আগের কথা। আমি তখন অক্সফোর্ডের ছাত্র। একদিন লাঞ্চ ব্রেকের সময় রিসিপশন থেকে একটি চিরকুট আসল, ‘শের আফজাল নামের একজন ফোন করেছিলেন। তিনি তোমার সঙ্গে কথা বলতেচান।’ বিদেশ বিভুঁয়ে একজন স্বদেশীর ফোন আমার জন্য লোভনীয় চমক ছিল এবং গায়বি মদদও। শের আফজাল সাহেবকে ফোন করলে তিনি রাতের খাবারের দাওয়াত করেন। তার ঘরে হাজির হয়ে বুঝতে পারলাম, তিনি কয়েক দশক ধরে সেখানকার বাসিন্দা। পাশাপাশি পাকিস্তানি সাংবাদিকতায় খুব আগ্রহী এবং দেশীয় কোন দল বা সংগঠনেরও প্রধান।

ছুটির দিন এক সন্ধ্যায় তার নিকট বসা ছিলাম। তখন একজন কাশ্মিরী পাকিস্তানী মুরুব্বি তার কাছে ইংরেজিতে দরখাস্ত লেখাতে আসেন। কথায় কথায় আমি ঐ লোককে জিজ্ঞেস করি, দেশের কোন জিনিসকে আপনি এখানে অনেক বেশি মিস করেন? উত্তর আসল, ‘আযান’। লোকটি দেশ ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে পাড়ি জমিয়েছে বহু যুগ আগে। কিন্তু এখনো সে তার পূর্বপুরুষের দেশের মহল্লার মসজিদ হতে ভেসে আসা আযানের শূন্যতা অনুভব করছে। আমি তরুণ ছিলাম । তাই কথাটি শুনলেও তাতে প্রভাবিত হইনি।

দশ-এগার বছর আগে আমি দু’সপ্তাহের জন্য তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ছিলাম। ইস্তাম্বুল আমার কাছে ‘ছোট মদীনার’ মতো মনে হয়। কারণ, সেখানে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুধভাই ছাড়াও অনেক সাহাবী ও মদীনা মুনাওয়ারার মহা মনীষীগণ সমাহিত আছেন। নয়নাভিরাম ইস্তাম্বুল সমুদ্রের উভয় তীরে পর্বতজুড়ে অবস্থিত। সন্ধ্যা হলে পেয়ালার মতো মনে হয়। মাগরিবের সময় যখন আমি খোলা চত্বরে বসতাম, তখন সারা শহর আযানের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠত। সমুদ্রের দু’কুল ঘেঁষা পর্বতমালা থেকে এখানে ওখানে উচ্চকিত অগণিত আযানের ধ্বনি আর সামনের সাগরের নীল জলের তরঙ্গ। মনে হত যেন পাহাড়গুলোর প্রতিটি পাথর থেকে নিয়ে পানির ঢেউ পর্যন্ত সবকিছু আল্লাহর ঘরের দিকে ডাক দিচ্ছে। হযরত সুলতান বাবু রহ.-এর ভাষায়, যেন প্রতিটি বস্তু আল্লাহর যিকিরে নিমগ্ন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা যেসব অন্তরকে তাঁর মারেফাতের নূর দ্বারা আলোকিত করেন, তারা নিশ্চয় এসব শুনতে এবং দেখতেও পান। এটা আমার রবের দান এবং নেয়ামত। তিনি যাকে চান এ মর্যাদা দান করেন। তা না হয় মানুষ তো জীবনভর জড় চোখের দৃশ্যেই বিভোর থাকে। যাকে আমরা বাতেনি চোখ বলি সেটা হল আত্মার চোখ এবং আল্লাহর নৈকট্যের দান। হযরত সুলতান বাবু রহ.-এর বাণী এ রহস্যের পর্দা উন্মোচন করে যা অনেক আধ্যাত্মিক সাধকেরও অনুভবের উর্ধ্বে। তার কবিতার মর্ম কিছুটা এরূপ- ‘অন্তর সমুদ্রের চেয়েও বেশি গভীর। তার চৌদ্দটি স্তর। যেগুলো তাঁবু ও শামিয়ানার ন্যায় টাঙানো। মানুষ যতই আল্লাহর নৈকট্যের ধাপগুলো অতিক্রম করে, এ তাঁবু আস্তে আস্তে সরতে শুরু করে। এবং কলব মারেফাতের নূরে আলোকিত হয়ে বস্তুবাদী পৃথিবীর সকল সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায়।

একবার ওমরা আদায় করার পর যোহরের নামাযের অপেক্ষায় আমরা পবিত্র কাবা শরীফের চত্বরে কাবার দিকে তাকিয়ে বসা ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু এবং মুরশিদ ভাই প্রফেসর যফর আলী আহসান মরহুমও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঐসময় জেদ্দায় পাকিস্তান স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। শুধু অল্প কয়েকজন জানত যে, মুরশিদের কল্যাণে তার আত্মা আলোকময় ছিল। খুশু-খুজু, বিনয়-ধ্যানের ঐমুহূর্তে তিনি হঠাৎ হেসে উঠলে আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, এইমাত্র সামনে দিয়ে মিয়াজী হাসতে হাসতে গেলেন।’ মিয়াজী আমার এবং তার মুরশিদ ছিলেন। সৌদি আরব থেকে সহস্র মাইল দূরে পাকিস্তানের একটি প্রদেশের কবরস্তানের ছোট্ট মসজিদে অবস্থান করছিলেন। মিয়াজীর ইন্তেকাল হয়েছিল ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে । বস্তুবাদের পর্দায় বন্দী আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না; কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান কাবা শরীফের চত্বরে বসে এক আল্লাহওয়ালার কথার প্রতি আমার অন্ধ বিশ্বাস ছিল।

কথা শুরু হয়েছিল আযান থেকে। মুসলিম দেশগুলোতে জীবন যাপনকারীদের ভাগ্যে সারা জীবনব্যাপী আযান জোটে। মুসলমান শিশুর যখন জন্ম হয় তখন তার কানে আযান দেয়া হয়। সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়, তখন তার জানাযার নামায পড়া হয়। সুফী-দরবেশদের মতে এই জীবন আযান থেকে নিয়ে নামায আদায় পর্যন্ত বিরতির সামান্য সময়ের ন্যায়। যাকে আমরা হিসাবের দাড়িপাল্লায় এক বছর, এক বছর করে মেপে থাকি। আর এ নির্মম বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে লুটপাট করি, অহমিকার শিকার হই, মিথ্যার বাজার গরম করি। আর সম্পদের স্তুপ জমা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি। তারপর একদিন খালিহাতে কবরে গিয়ে গড়িয়ে পড়ি।

কয়েক বছর আগে আমি রমযানের বরকতময় মাসে আমেরিকায় ছিলাম। সেখানে সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই যে জিনিসটি আমি  তীব্রভাবে অনুভব করতাম, সেটা লাহোরের অলিগলি এবং বাজারের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসা আযানের ধ্বনি। আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন, নিসবত বা সম্পর্ক মানুষকে কী থেকে কী বানিয়ে দেয়? আধ্যাত্মিক নিসবত বা সম্পর্ক হল পৃথিবীর রহস্য। কিন্তু এর ছিঁটেফোঁটা এ জড় পৃথিবীতেও দেখতে পাওয়া যায়।

আনুমানিক ত্রিশ বছর আগে আমি সিরিয়ার রাজধানী দামেশকে হযরত বেলাল রা.-এর কবরের কদম বরাবর দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলাম যে, গলায় রশি লাগিয়ে টানা-হেঁচড়া করা গোলাম, মক্কায় যার অবস্থান পশুর চেয়েও নিচু ছিল- নিসবত ও সম্পর্ক তাকে মর্যাদার কোন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে, বেলালি আযানকে এক মহান নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছে, এবং হযরত বেলাল রা. -এর পবিত্র নামকে কেয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় আলোকজ্জল করে দিয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর মদীনা মুনাওয়ারার কান, অলিগলি, দরজা ও দেয়ালগুলি হযরত বেলাল রা.-এর আযান শুনতে ব্যাকুল ছিল। একবার নিসবতের টানে তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় হাজির হলেন। অনুরোধ ও পীড়াপীড়ির পর আযান দিতে শুরু করলেন। কিন্তু অর্ধেক পর্যন্ত যাওয়ার পর বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। এরপর নববী দরবার থেকে দূরে চলেন গেলেন। কারণ, মনিবের স্মৃতি বড় দুঃসহ ছিল।

আমি তাঁর কবরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলাম, সুবহানাল্লাহ! হযরত বেলাল রা.-এর কত মহান মর্যাদা! নববী মুয়াজ্জিনের কী শান! দোজাহানের সরদার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মেরাজ থেকে ফিরে আসার পর হযরত বেলাল রা. কে সুসংবাদ শোনালেন যে, আমি তোমার পায়ের আওয়াজ জান্নাতে পেয়েছি। হযরত বেলাল বলেছিলেন, আমি ওযু ভঙ্গ হলেই পুনরায় ওযু করে নেই। অর্থাৎ ওযু অবস্থায় থাকি সর্বক্ষণ । আল্লাহর প্রিয় বান্দা জাগ্রত অবস্থায় সবসময় ভেতরে ও বাইরে ওযু অবস্থায় থাকেন। হযরত বেলালের খেদমতে শ্রদ্ধার নযরানা পেশ করার পর অন্তরে একটি ইচ্ছার উদয় হল। হযরত বেলাল রা.-এর আযান আজো মদীনা মুনাওয়ারার আকাশে-বাতাসে কোথাও না কোথাও সংরক্ষিত থাকার কথা। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তাঁর হাবীবের বন্ধুদের সবকিছু জীবন্ত রাখেন। হায়, আমি যদি সেটা শুনতে পেতাম! হায়! সে আযান যদি আমার অস্থিমজ্জা, শিরা-উপশিরায় মিশে যেত। হায়…!

ভাষান্তর: সাইফ নূর

পূর্ববর্তি সংবাদটেকনাফে বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ২, বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদপটুয়াখালীতে মাদক সেবন নিয়ে প্রকাশ্যে ২ কলেজছাত্রকে কুপিয়ে জখম, ভিডিও ভাইরাল