সৌদি রাজ পরিবারে গ্রেফতার অভিযান, যুবরাজ এমবিএসের ক্ষমতা পাকাপোক্ত

টিপু সুলতান ।।

মুহাম্মাদ বিন সালমান ওরফে ‘এমবিএস’ সৌদি রাজপরিবারের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন; কিন্তু তার নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব এখনো দৃশ্যপটের আড়ালে। আর্থিক দুর্নীতি বিরোধী এ অভিযান তার পায়ের তলার মাটিকে আরো নিষ্কন্টক ও সুদৃঢ় করতে সহায়তা করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সৌদি রাজ সিংসাহনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান সৌদি রাজত্বের অতিশয় ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তি। সাধারণত তিনি এমবিএস নামে পরিচিত। চলতি সপ্তাহে তিনি আরেকবার রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ দু’জন ব্যক্তিকে আর্থিক দুর্নীতির দায়ে পদচ্যুত করেছেন।

তাদের একজন লেফট্যানেন্ট জেনারেল ফাহাদ বিন তুর্কী বিন আবদুল আযীয। যিনি ইয়েমেনে যুদ্ধরত সৌদি সেনাজোটের কমান্ডার এবং একজন যুবরাজও বটে। অপরজন তার ছেলে যুবরাজ আবদুল আযীয বিন ফাহাদ বিন তুর্কী। যিনি সৌদির উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত আলজাওফ প্রদেশের সহকারী গভর্নর ছিলেন।

এমবিএস তাদের পদচ্যুতি বিষয়ে সৌদি এন্টি করাপশন অথরিটি (দুর্নীতি দমন কমিশন) ‘নাযাহা’কে দায়িত্ব অর্পন করেন। সৌদি আরবের সরকারি গণমাধ্যম এজেন্সি মঙ্গলবার জানিয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সন্দেহযুক্ত আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তদন্তের সূচনা করে ফেলল।

প্রয়োজন-অতিরিক্তি দুর্নীতি

মুহাম্মাদ বিন সালমান ২০১৭ সালে সিংসাহসনের উত্তরাধিকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক পরিসরে অভিযানে নেমে পড়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক বেনহোবার্ড সংকলিত মুহাম্মাদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী, রাজ পরিবারের সদস্যরা সৌদি ব্যাংকগুলো থেকে পরিশোধ করা ছাড়াই ঋণ গ্রহণ করত। আর পুঁজিবাদীদের পরামর্শদাতা রূপে কর্মরত যুবরাজরা অভ্যন্তরীণ তথ্য আদানপ্রদানও করত।

২০১৭ সালের নভেম্বরে এমবিএস এক ব্যাপক অভিযানে রাজপরিবারের সাবেক ক্ষমতাধরদের আনুমানিক ৩৫০ সদস্যকে গ্রেফতার করেন। পরবর্তীতে তাদের রিয়াদের রিটজ কার্লটন হোটেলে বন্দী করে রাখা হয়।

যুবরাজের পলিসি সৌদি আরবের অবস্থানকে উন্নত করতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন পশ্চিমা গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৯ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে সৌদি আরব ছয় ধাপ অগ্রসর হয়ে ১৮০টি দেশের তালিকায় ৫১তম অবস্থানে উঠে এসেছে। তালিকাতে সৌদি আরব- ইতালি, রুয়ান্ডা এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সমান্তরালে পৌঁছে গেছে।

সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর অস্পষ্ট সম্পত্তি

মুহাম্মাদ বিন সালমানের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে রয়েছে স্ববিরোধিতা। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক বেনহোবার্ড-এর তথ্যমতে, গ্রেফতারকৃতদের বাছাইকরণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ, আটককৃত এই লোকদের কোম্পানিতে এমবিএস নিজেই পুঁজি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন।

বিদেশী সমালোচকরা মনে করেন, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষেত্রে খুবই কম স্বচ্ছ। উদাহরণস্বরূপ, তার নিকট ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল প্রমোদতরী ক্রয়, প্যারিসের অদূরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের Château Louis XIV নামের দুর্গ কেনা এবং ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের লিউনার্দো না ভিঞ্চির পেইন্টিং কেনার অর্থের উৎস কী?

আরো পড়ুন: সৌদি যুবরাজের মহা-বিলাসী জীবন, গোপন দ্বীপ আর প্রমোদতরীর ‘বিশেষ জগত’

প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়া

সৌদির অঘোষিত এই যুবরাজের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে এ বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসে গেছে যে, এমবিএস কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সহ্য করবেন না। কারণ, তিনি ভয় পান, এই প্রতিপক্ষ যে কোনো সম্ভাব্য ভুলের সুযোগ নিয়ে তার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

এমবিএসের আর্থিক অস্বচ্ছতার পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধেও লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এ বছর মার্চে এমবিএস সৌদির সরকারি কর্মকর্তাদের প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেক উচ্চপদস্থ শাহযাদাও শামিল রয়েছে। তাদের ওপর মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান বাদশাহর ছোট ভাই এবং আদরের ভাই শাহযাদা আহমদ বিন আবদুল আযীয এবং সন্ত্রাস দমন কমিশনের প্রধান প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন নায়েফও তাদের মধ্যে ছিলেন।

ইসলামবিরোধী অবস্থান

যদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মুহাম্মাদ বিন সালমান ভবিষ্যতে নিজের পিতা সালমানের উত্তরসূরী হন, তাহলে তিনি সৌদি রাজপরিবারের নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। বর্তমান বাদশাহ এবং তার পূর্ববর্তী বাদশাহগণ সৌদি রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আযীয বিন আলে সউদ এর পুত্র ছিলেন। সেক্ষেত্রে এমবিএস হবেন প্রথম নাতি রাজা। যদিও বিষয়টি অত নিশ্চিত করেও বলা যায় না। কারণ, এমবিএস সংক্ষিপ্ত সময়েই অনেক শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থবিরোধি চরম বিতর্কিত পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করেননি। ৩৪ বছর বয়সী এই যুবরাজ  পুরোপুরি পশ্চিমা  চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক। তার ইহুদিপ্রীতি, ইসলাম ও উম্মাহ বিরোধী কাজকর্মে বিশ্ব মুসলিমের আস্থা হারিয়েছেন তিনি।

নারীদের ড্রাইভিং, অশ্লীলতার প্রসার, মক্কা-মদীনায় পশ্চিমা অশ্লীল ফটোশুটের অনুমোদন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সখ্যতা, ইসরাইলের জন্য সৌদির আকাসসীমা উন্মুক্তকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপের কারণে এমবিএস মুসলিম উম্মাহর চরম ‍ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন।

সৌদিতে স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করা মানে হলো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। সৌদি আলেমদের গুম, খুন ও কারাবরণের ঘটনাবলি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। একইভাবে মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই এখন সৌদির জেলে রয়েছেন শুধু সরকারবিরোধী সত্য উচ্চারণ করার কারণে। তাদের মধ্যে অনেক নারীও আছেন। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোকজী হত্যার পেছনে এমবিএসের সন্দেহমূলক ভূমিকা বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তিকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সূত্র: ডয়চে ভেলে।

পূর্ববর্তি সংবাদস্কুল খোলা না গেলে ‘অটোপাস’ করিয়ে দেওয়ার আভাস
পরবর্তি সংবাদনারায়াণগঞ্জ ট্রাজেডির দায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না: মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী