ফিরে দেখা রক্তঝরা ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮)

সাইফ নূর ।।

মঙ্গলবার ২২ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ ইরাক-ইরান যুদ্ধের ৪০ বছর। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন ইরান সীমান্তে তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। একই দিনে ইরানের ১০টি বিমান ঘাঁটির ‍ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়েছিল ইরাকি বিমানবাহিনী। এভাবেই শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশের ৪০ বছরের পুরনো নিষ্ফল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট:

ইরাক তার যুদ্ধ শুরুর কারণ হিসেবে দক্ষিণ ইরাকে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের হত্যা প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে। সাদ্দাম হোসেনের ভাষায় “ইরানী এজেন্ট” রা এ হামলার পেছনে দায়ী ছিল।

১৯৮০ সালের মার্চ মাসের মধ্যে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। উভয় দেশই অপর দেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। এ ঘটনার তিনদিন পরেই এক নিহত ছাত্রের জানাযায় পুনরায় হামলার ঘটনা ঘটে। ইরাক ইরানকে দোষারোপ করে সেপ্টেম্বর ১৯৮০ তে ইরানের উপর হামলা চালায়।

১৭ সেপ্টেম্বর , পার্লামেন্টে এক ভাষণে সাদ্দাম হোসেন বলেন , “ইরাকী সার্বভৌমত্বে উপর্যুপরি এবং নির্লজ্জ ইরানী হস্তক্ষেপ ১৯৭৫ সালে স্বাক্ষরিত আলজিয়ার্স চুক্তিকে ইতিমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে। শাতিল আরব নদী ঐতিহাসিক এবং নামকরণের দিক থেকে ইরাকের এবং আরবদের একচ্ছত্র অধিকারে ছিল। এর উপর ইরাকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’’

ইরাক সরকারের লক্ষ্য ছিল: ১.শাতিল আরব নদীর মোহনা নিজেদের দখলে নেয়া। ২. সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে তিনটি ইরানী দ্বীপ আবু মুসা, গ্রেটার টুনব এবং লেসার টুনব দখল করে নেয়া। ৩. ইরানের খুজেস্তান প্রদেশ ইরাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া। ৪. তেহরানের শিয়া ধর্মীয় সরকারকে উৎখাত করা। ৫. এই অঞ্চলে শিয়াদের ‘ইসলামী বিপ্লব’ ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনাকে উৎপাটন করা।

অপরদিকে ইরান মনে করে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মূল কারণ ছিল পারস্য উপসাগরের ওপর একচেটিয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্খা । এই স্বপ্নটি দেখত সাদ্দাম। ১৯৭৯ সালে ইরানে ‘ইসলামী বিপ্লবের’ ফলে মার্কিন সরকারের সেবাদাস ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজা শাহের পতন ঘটলে সাদ্দাম ইরান-বিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করে।

ইরানিদের মতে, সাদ্দাম তার দৃষ্টিতে এটা বুঝতে পারে যে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার নিয়োজিত লাঠিয়ালের সেই পদটি খালি হয়ে গেছে। যেই পদে আসীন ছিল বিপ্লবপূর্ব ইরানের রাজা। তাই সাদ্দাম নিজেই এই খালি পদটি দখল করতে আগ্রহী হয়। তবে এ জন্য ইরাকের পাশে পানির বা সমুদ্রের যথেষ্ট সীমানা থাকা দরকার এবং একই কারণে পারস্য উপসাগরের ওপরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা জরুরি ছিল বিধায় সাদ্দাম দাবি করে যে, ইরান ও ইরাকের সীমান্ত বিরোধ নিরসনের জন্য ১৯৭৫ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে বাগদাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কিন্তু ইরাক যুক্তি দিয়েছিল, যুদ্ধ আসলে শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর। ওই সময় ইরাকের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে গোলা নিক্ষেপ করেছিল ইরান। সাদ্দাম হোসেন দাবী করেন, অন্যান্য আরব এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রে ইরান তাদের বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র করছে, তা রুখতেই মূলত এই অভিযান।

যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ:

ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৮০ সালে। সেপ্টেম্বরের একদিনে সাদ্দাম হোসেন ইরানে সৈন্য পাঠালেন। তারপর সেই লড়াই বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম যুদ্ধগুলোর একটিতে রূপ নেয়। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল ইরাক-ইরান যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রথম দিকে ইরাকের পাল্লা ভারি থাকলেও  কার্যত তাতে তেমন ফল আসেনি। ১৯৮২ সালের জুনের মধ্যে ইরান তার হারানো সব ভূখন্ড  পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরের ৬ বছর ইরানি বাহিনী যুদ্ধে অগ্রসর ভূমিকায় ছিল। জাতিসংঘের বারবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৩ সালে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধবন্দী বিনিময় ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলের সঙ্গে এ যুদ্ধের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পরিখা, কাঁটাতার, মানব স্রোত, বেয়োনেট চার্জ এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানি সৈন্য, বেসামরিক নাগরিক এবং ইরাকি কুর্দিদের ওপর রাসায়নিক গ্যাস এবং মাস্টারড গ্যাস প্রয়োগ করে।

টানা আট বছর যুদ্ধ চলে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অনেক দেশ ও আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরাককে সমর্থন করতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে ইরান। বাধ্য হয়ে তারা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে একটি শান্তিচুক্তি মেনে নেয়।

আধুনিক ইতিহাসে ওই যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ, প্রাণঘাতী। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল রাসায়নিক অস্ত্র। উভয় দেশে মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ। আহত হয়েছেন আরো অগণিত মানুষ। নিখোঁজ হয়েছেন কতজন তার ইয়ত্তাই নেই। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে ইরানের খোররমশাহ  শহরের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় রক্তক্ষয়ী নগর যুদ্ধের। উভয় পক্ষের প্রায় ৭ হাজার করে যোদ্ধা এতে নিহত হন।  বিপুল রক্তক্ষয়ের কারণে সেসময় খোররামশাহ উভয়পক্ষের কাছেই “খুনিস্তান”(রক্তের শহর) নামে পরিচিত ছিল।

ঐসময় মুসলিম অধ্যুষিত এই দুই দেশের সংঘাত বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও শান্তি প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো হয়। দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আধ্যাত্মিক বুযুর্গ মরহুম মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সরাসরি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খোমেনীর সঙ্গে সাক্ষাত করে শান্তি আলোচনার প্রচেষ্টা অনেক দূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৎকালীন বিশ্বে তার এই মহতি উদ্যোগ ব্যাপক আলোচনা ও প্রশংসার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দু’দেশের আন্তরিকতার অভাবে তা আলোর মুখ দেখেনি।

রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও কোনো দেশকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয় নি। যেখান থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল উভয় দেশের সেনাবাহিনী তাদের সেই অবস্থানে ফিরে যায়।

এই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে দুই দেশে শুধু যে অকাতরে প্রাণহানি হয়েছে এমন নয়। অর্থনীতি ধসে পড়ে। তার প্রভাব পড়ে পুরো অঞ্চলে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে পলিটিক্যাল ডিসিশন সেন্টারের চেয়ারম্যান হাদি জালো মারি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক সংস্কৃতি চালু করেছে ইরান-ইরাক যুদ্ধ। এই সংস্কৃতিতে প্রভাব রয়েছে নতুন নতুন সব বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামরিক লিগ্যাসির। যুদ্ধে একদিকে প্রাণহানি ঘটেছে, অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে ওই দুটি দেশে। কিন্তু তার প্রভাব পড়েছে দুই দেশের সীমান্তের বাইরেও। এই যুদ্ধের ফলে পুরো অঞ্চলটি বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটি জাতিগোষ্ঠীতে। এর মধ্যে একটি হলো সুন্নি নেতৃত্বাধীন ইরাক এবং অন্যটি হলো শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরান।

শত শত কোটি ডলার ঋণ নিয়ে বিরোধে ১৯৯০ সালে কুয়েতে আগ্রাসন চালান ইরাকের প্রয়াত নেতা সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু সেই আগ্রাসনের ওপরও ছায়া ফেলে এ ঘটনা। কুয়েত আগ্রাসনের কারণে ইরাকে প্রথম আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়। তাতে ক্ষমতাচ্যুত হন সাদ্দাম হোসেন।

সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, এই যুদ্ধে ইরাক-ইরানের মানুষের রক্তপাত আর ব্যাপক প্রাণহানি ছাড়া কোনো অর্জন নেই। এর মাধ্যমে ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর এই দুই দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাভবান হয়েছে শুধু তারা- যারা এই যুদ্ধে অস্ত্র বিক্রি করতে পেরেছে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উচ্চসুদে ‍ঋণ দিয়েছে। যারা শিয়া-সুন্নি মতবিরোধকে রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের ইন্ধনস্বরূপ ব্যবহার করতে পেরেছে, প্রকৃতপক্ষে তারাই লাভবান হয়েছে। পরবর্তী দশকগুলোতে ইরাক ও ইরানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নানামুখী আগ্রাসন-হস্তক্ষেপ যার সবচে বড় প্রমাণ।

পূর্ববর্তি সংবাদআইপিএল নিয়ে জুয়া, কুড়িগ্রামে ১৯ জন আটক
পরবর্তি সংবাদ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ইলিশ উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন