নবীজির সুন্নত জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টাই রবিউল আউয়ালের শিক্ষা

মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী ।।

চলছে রবিউল আউয়াল মাস। যে মাসে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন। ইসলামে দিবস পালনের সুযোগ থাকলে সর্বশ্রেষ্ঠ পালনযোগ্য হতো নবীজীর জন্মদিবস। যেদিন আল্লাহ তাআলা মানবতার পথ প্রদর্শনের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এমন এক সত্ত্বাকে, যাকে জগত সৃষ্টির মূল বললে ভুল হবেনা। ‘لولاك لما خلقت الأفلاك’ হাদীসটি সনদের দিক থেকে বানোয়াট হলেও অর্থের দিক থেকে সম্পূর্ণ সঠিক। বাস্তবেই তার সত্ত্বা সমগ্র সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। তিনি দুনিয়ায় না এলে আল্লাহ পাক কিছুই সৃষ্টি করতেন না। আসমান-জমিন, পাহাড়-সাগর কিছুই না। তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের দিন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত, বরকতময় ও সৌভাগ্যের দিন।

ইসলামে জন্ম দিবস পালনের সুযোগ থাকলে এদিনটিই হতো ঈদ পালন-আনন্দ উদযাপনের সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হলো, কারো আগমনে আনন্দ প্রকাশ করার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তার অনুসরণ করা। যে পয়গাম নিয়ে তিনি এসেছেন, যে শিক্ষা তিনি দিয়েছেন এবং যে হেদায়েতের বানী শুনিয়েছেন, তার ওপর কতটুকু আমল হলো সেটাই লক্ষণীয়। আনন্দ অনুষ্ঠান সব ধর্মে আছে। ইসলামে আছে দুটি ঈদ। ইসলামের ঈদ অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানের বিপরীত, যা সুনির্দিষ্ট কোন দিবস কেন্দ্রীক নয়। ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতর। অতীত কোনো ঘটনা বা কারো জন্ম-মৃত্যুকে উপলক্ষ করে দিনটি ধার্য করা হয়নি। ১০ জিলহজ ঈদুল আজহাও বিশেষ কোন দিন বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নয়। যদিও কুরবানী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নত। কিন্তু তিনি জিলহজের ১০ তারিখেই কুরবানি করেছেন, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। তাই এটা বলার সুযোগ নেই যে, তাঁর কুরবানীকেই উপলক্ষ করে ১০ জিলহজ ঈদ পালন করা হয়।

মোটকথা, ইসলামের ঈদ কোনো অতীত উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন শেষে আসে ঈদুল ফিতর। এই বার্তা নিয়ে, পূর্বসূরীর কৃতিত্বে আনন্দিত-গর্বিত না হয়ে নিজের আমল দেখো। তুমি যদি এক মাস রোজা রেখে থাকো, আল্লাহ পাকের ইবাদত করে থাকো, তবেই তুমি আনন্দ উদযাপন, ঈদ পালনের যোগ্য। অনুরূপ, ঈদ-উল-আযহাও আসে বড় এক ইবাদত অর্থাৎ হজের পর। সুতরাং বোঝা গেলো, ইসলামের ঈদ দুটো বড় ইবাদতকে কেন্দ্র করে। হযরত ঈসা আ. এর জন্মদিন স্মরণে খৃষ্টানরা পালন করে ক্রিসমাস ডে। হযরত মুসা আ. ফেরআউনের হাত থেকে মুক্তি লাভের দিনকে স্মরণ করে ইহুদিরা ঈদ পালন করে। আর আমাদের ইসলামের শিক্ষা, অন্যদের মতো পূর্বসূরীর কৃতিত্বে আনন্দিত না হয়ে নিজের কৃতিত্ব দেখ, নিজের আমল শেষে ঈদ পালন কর।

জন্মদিবসে ঈদ পালন করা ইসলামী চিন্তাধারার বিপরীত বলেই তো সাহাবীদের যুগে সুদীর্ঘ একশ বছরে একবারও কেউ নবিজীর জন্মদিনে ঈদ পালন করেন নি। অথচ তারা নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এতটা আশেক ছিলেন, তাঁর থুথুও জমিনে পড়তে দিতেন না, শরীরে মেখে নিতেন। অপরদিকে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নিয়ে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। কারো মতে ৩, কারো মতে ৯, আবার কারো কারো মতে ১২ রবিউল আউয়াল। নবীজীর জন্ম তারিখে মতানৈক্য হওয়াই প্রমাণ করে যে, সাহাবায়ে কেরাম তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। তারা বরং নবীজীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। প্রতি মুহূর্তে নবীজির সুন্নত ও সীরাতের অনুসরণে ডুবে থাকতেন তাঁরা। এসব দিবস পালন-আনন্দ অনুষ্ঠান করার সময় ছিলো না তাদের।

আরেকটি বিষয়, ঈদে মিলাদুন্নবীতে কত অনুষ্ঠান হয়, ভাষণ-বক্তৃতা হয়, কত নাত-গজল পড়া হয়, মিলাদ-মাহফিল হয়। এত আয়োজন করে আমাদের জীবনে কি কোনও পরিবর্তন আসে? নবিজীর সুন্নত-আদর্শকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা তৈরী হয় কি? মোটেও না। জীবন আগে যেমন ছিলো তেমনই থাকে।

ভেবে দেখুন, নবীর শানে শত শত নাত-গজল মিলাদ-মাহফিল হলো, কিন্তু নবীজী দুনিয়াতে আসার মূল উদ্দেশ্যটিই বাস্তবায়ন হলো না, এর দ্বারা কি তিনি খুশি হবেন? তিনি কি শুধু তাঁর নাত-প্রশংসা শুনতেই দুনিয়ায় এসেছিলেন? যেই আদর্শ পৌঁছাতে এসে দ্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘তারা আমার এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি পিছু হটবো না’ সেই আদর্শ আজ কোথায়? নাত-গজলই যদি উদ্দেশ্য হতো তবে কেন তিনি সারা জীবন এত কষ্ট-মোজাহাদা করে গেলেন!

আরো আফসোসের বিষয় হচ্ছে, অনেক সময় নবীর মহব্বতের মিলাদ-মাহফিলে হয় নবীজীর অপছন্দের সব কাজ। মাহফিলের আয়োজনের ব্যস্ততায় ফরজ নামাজই ছুটে যায়। এমনকি নারী-পুরুষের পর্দাহীন সহাবস্থানও দেখা যায়। তার চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার, যেই বাদ্যযন্ত্রকে মিটাতে নবীজি দুনিয়ায় এসেছিলেন, সেই মিউজিক বাজিয়ে অনেকে তাঁর শানে নাত পাঠ করে।

নবীজির সাথে এ কেমন ইনসাফ! তাঁর শিক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে তাঁর নামে আনন্দ অনুষ্ঠান!

আমার ভাইয়েরা, সংক্ষিপ্ত কথা হলো, এসকল আনুষ্ঠানিকতায় বিন্দুমাত্র লাভও হয় না। ক্ষেত্র বিশেষ বড় ধরনের গুনাহ হয়। তাই এ সকল ভিত্তিহীন আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করে অন্তত এই হিসেবটুকু করি, কোন কোন সুন্নতের উপর আমি আমল করছি না। আজ থেকেই তার ওপর আমল শুরু করে দেই। প্রকৃত মুমিন নবীজির সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে। এমন অসংখ্য সুন্নত রয়েছে যেগুলোর উপর আমল করতে মোটেও কষ্ট হয়না। ড. আব্দুল হাই আরেফী রহ. এর কিতাব ‘উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম’ সংগ্রহ করে সবাই নবীজীর সুন্নতগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো। এটাই রবিউল আউয়ালের শিক্ষা।

অনুবাদ: মাওলানা নূরুদ্দীন আজিম 

পূর্ববর্তি সংবাদ‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবে না’
পরবর্তি সংবাদরিফাত হত্যা: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি বরিশাল কারাগারে