বাকস্বাধীনতার ঠিকাদার!

ইয়াসির পীরযাদা ।।

আমেরিকার ২৭ টি রাজ্যে ইসরাইলি পণ্য বয়কটকারী কোম্পানি, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তির আইন রয়েছে। যতগুলি রাজ্যে এই আইন রয়েছে, সবগুলো আমেরিকার মোট আয়তনের ৭৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, আমেরিকার সিনেটর ও সংসদ সদস্যরাও ইসরাইলি পণ্য বয়কটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করে রেখেছে। আমার প্রশ্ন, বয়কটের চেয়ে উত্তম প্রতিবাদ কী হতে পারে? এটা আইনসঙ্গতও, আবার অহিংসও। কিন্তু ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে আমেরিকায় এইটুকু প্রতিবাদেরও অনুমতি নেই।

আমেরিকা বাদ দিয়ে আসি ইউরোপে। গেলো সপ্তাহে ফ্রান্স রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননাকর কার্টুন সারাদেশে  সরকারি ভবনের গায়ে প্রদর্শন করেছে। ফ্রান্স সরকার ন্যক্কারজনক এই কাজটি করেছে ইতিহাসের শিক্ষক স্যামুয়েল পেটির স্মরণে। যাকে  কিছুদিন পূর্বে একজন মুসলিম তরুণ শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের সামনে অবমাননাকর চিত্র প্রদর্শনের কারণে হত্যা করেছিল।

ফ্রান্সের সরকার, সমাজ এবং রাজনীতি নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের প্রশ্নে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ইউরোপে ফ্রান্সই প্রথম দেশ, যারা গণ-যাতায়াতের স্থানে হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই যে, এ ক্ষেত্রে কোনরূপ বাধা-প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারবে না। ধর্মীয় বাঁধা তো একদমই নয়।

কথাগুলো বাহ্যিকভাবে বেশ শক্তিশালী মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, অবমাননাকর চিত্র প্রদর্শন এবং বাকস্বাধীনতার সীমা নির্ধারণে ফ্রান্সের যুক্তি নিতান্তই  ঠুনকো এবং দুর্বল। স্বয়ং ইউরোপের মানবাধিকার সংরক্ষণ আদালত ২০১৮ সালে এই রায় দিয়েছিল যে,  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে নাউযুবিল্লাহ কুৎসা রটানোর অপচেষ্টা করা (goes beyond the permissible limits of an objective debate) ‘বিতর্কের অনুমোদিত সীমা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অতিক্রমের শামিল’।

এই মামলা প্রথমে ভিয়েনার আঞ্চলিক ফৌজদারি আদালতে চলে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ান এক নারীকে এ অপরাধেই সাজা শোনানো হয়। পরবর্তীতে সেই নারী সাজার বিরুদ্ধে আপিল করে বলেছিল,  ইউরোপের মানবাধিকার আইনের বাকস্বাধীনতা বিষয়ক ১০ নং ধারা অনুযায়ী তিনি নিজের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন।

কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাত সদস্যবিশিষ্ট বিচারকের বেঞ্চ ওই নারীর যুক্তি খন্ডন করে রায়ে লিখেছেন, that by considering the impugned statements as going beyond the permissible limits of an objective debate and classifying them as an abusive attack on the Prophet of Islam, which could stir up prejudice and put at risk religious peace, the domestic courts put forward relevant and sufficient reasons. ‘আদালত প্রাসঙ্গিক এবং পর্যাপ্ত যুক্তিপ্রমাণ সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কে অনুমোদিত সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া এবং ইসলামের নবীর উপর অবমাননাকর আক্রমণ করা সহিংসতা জাগাতে পারে এবং ধর্মীয় শান্তিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।’

বাকস্বাধীনতার সীমারেখা নির্ধারণে এটা ইউরোপের সবচেয়ে বড় আদালতের রায়। মৌলিকভাবে তো এ রায়ের আলোকে ফ্রান্সের সব যুক্তি আইনত ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু ফরাসিরা যেহেতু বাকস্বাধীনতার ‘ঠিকাদার’ বনে বসে আছে (!) তাই আমরা তাদের এই অবস্থানের আরেকটু পোস্টমর্টেম করে নিতে চাই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে ফ্রান্স কী এমন মহান উদ্দেশ্য সাধন করে ফেলেছে! হ্যাঁ, এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে একশ নব্বই কোটি মুসলমানের অন্তরে কষ্ট দেওয়া এবং পৃথিবীর শান্তিকে বিঘ্নিত করা তাহলে তাদের এ উদ্দেশ্য অবশ্যই পূরণ হয়ে গেছে।

যদি ফ্রান্সের যুক্তি এটা হয় যে, এ প্রদর্শনের দ্বারা ওই নিহত শিক্ষকের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা,  তবে এটা অসম্পূর্ণ যুক্তি । কেননা, কারো প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য এটা আবশ্যক নয় যে, আপনি তার সকল চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে সেটা প্রকাশ্যেও প্রচার করে বেড়াবেন ।

উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো লেখকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় তবে এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য এটা আবশ্যক নয় যে, প্রথমে আমি তার সমস্ত চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হব, আর তারপর প্রতিবাদ করব।

আর যদি ফ্রান্সের যুক্তি হয় তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার সুরক্ষার জন্য এসব করেছে, তবে একথাও ধোপে টেকে না। কারণ, সেক্যুলারিজমের যেই সংজ্ঞাই করা হোক, সর্বাবস্থায়ই কোন ধর্ম বা তার নবীর অবমাননাকর কার্টুন তৈরি করে সারাদেশে প্রদর্শন করাটা তার আওতাভুক্ত করা সম্ভব নয়।

একইভাবে ফ্রান্সের লাইব্রেরীগুলোতে ইসলাম সম্পর্কিত  হাজারো-লাখো বই-পুস্তক থাকবে, যেখানে ইসলামকে বিষোদগার করে গবেষণা ও সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কেউ তো এ দাবি করে না যে, এসব গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হোক বা সেখানকার লাইব্রেরীয়ানদের মুণ্ডু কেটে ফেলা হোক।

সমস্যা  সৃষ্টি হয় তখন, যখন বাকস্বাধীনতার নামে আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননাকর চিত্র প্রদর্শন করা হয়,  আবার একইসাথে এ আশাও করা হয় যে, মুসলমানরা কোনও প্রতিবাদ জানাবে না। প্রতিবাদ জানালেই তারা ইসলামি সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত হবে।

প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার অধিকার তো কেবল আমেরিকা, ইসরাইল ও ইউরোপের রয়েছে! তারা যখন চাইবে, নিজেদের স্বার্থের নামে, নিজেদের ‘পশ্চিমা সম্মানের’ আড়ালে অথবা নিজ দেশের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুঁজি করে যে কোনও মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ করতে পারে! বোমা মেরে লাখো বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করতে পারে! গরীব দেশগুলোর ওপর জেঁকে বসে কলোনি বানাতে পারে! কিন্তু তাদেরকে কেউ জিজ্ঞেসও করতে পারবে না। কারণ, তারা যে ‘সভ্য’ রাষ্ট্র!

এসমস্ত তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলো এটাও নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার সীমানা তোমাদের পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা থেকে শুরু হয় আর ইসরাইলকে বয়কট করার উস্কানি পর্যন্ত এসে থেমে যায়।

এই দ্বিমুখী ও স্ববিরোধী মাপকাঠি মনে রাখলে এসব অবমাননাকর কার্টুন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যও বুঝে আসবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে মূলত এ বদমায়েশির প্রদর্শন তাদের বেশি উদ্দেশ্য যে, আমরা যা ইচ্ছা তাই করব। আমাদের মর্যাদা, আমাদের সেক্যুলারিজম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের ধর্ম, তোমাদের অনুভূতি, তোমাদের বিশ্বাসকে আমরা জুতোর নিচে রাখি।

একদিকে ইসরাইল- দুই ফিটের একটি দেশ, যারা আমেরিকার নাকে পর্যন্ত লাগাম দিয়ে রেখেছে। অপরদিকে একশ নব্বই কোটি মুসলমান, যারা সবাই মিলেও ফ্রান্সকে বাধ্য করতে পারছে না, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসম্মানকারী পোষ্টার প্রদর্শনের কারণে অন্তত ক্ষমাটুকু চেয়ে নিতে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ও সৌদি প্রিন্স এমবিএসের অন্তরঙ্গ ছবি

নিজেদের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখুন, কারণ বুঝে আসবে। যে জাতি আমেরিকা-ইউরোপের নাগরিকত্ব পেলে স্টেটাস দেয়, ‘আলহামদুলিল্লাহ, গেট আমেরিকান ন্যাশনালিটি’  সে জাতি আর যাই হোক, ক্ষমতাধরদের কাছে  মাফ চাওয়ার দাবি করতে পারে না।

উর্দু জিও নিউজ থেকে ভাষান্তর: আবু হিশাম 

এস আই

পূর্ববর্তি সংবাদঅনলাইনে নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে সরাসরি
পরবর্তি সংবাদমতামত জরিপ: ৬০ শতাংশ ইসরাইলি নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় চান