কয়েকজন নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী শাসক যাদের হাত বারবার রক্তে রঞ্জিত

জুলকিফল সরকার ।।

নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ীরা সত্যিকারের ‘শান্তির চ্যাম্পিয়ন’।কিন্তু ইতিহাসে এমন অনেককেই পাওয়া যাবে যারা নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের পর যুদ্ধ আর গণহত্যার মতো অপরাধের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে কলঙ্কিত করেছেন। তাদেরই অন্যতম বারাক হোসেন ওবামা, মিয়ানমারের সূচি এবং অতি সাম্প্রতিক কালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবিই আহমেদ।

শপথ নেয়ার মাত্র নয় মাসের মাথায় নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সম্প্রতি প্রকাশিত তার আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন: ‘কীসের জন্য?’

প্রতি ঘণ্টায় তিনটি বোমা

অসলোতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন আগেই আফগানিস্তানে আরো ৩০ হাজার সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ওবামা। পুরস্কার গ্রহণের পর দেয়া বক্তব্যে তিনি যুদ্ধের অধিকার নিয়ে নিজের অবস্থানের সাফাইও গান। ‘রাইট টু গো টু ওয়ার’ কথাটি তিনি বলেছেন মোট ৩৫ বার, অথচ বিশ্ব শান্তির কথা বলেছেন ২৯ বার।

ওবামা বলছিলেন, শক্তি প্রদর্শন কখনো কখনো দরকারী, যার নিন্দা করার সুযোগ নেই, এটা ইতিহাসস্বীকৃত।

ইরাক ও আফগানিস্তানের সংঘর্ষ থামাতে ব্যর্থ তো হয়েছেনই, উল্টো দেশ দুটিতে ড্রোন হামলার তীব্রতা তিনি বাড়িয়েছেন। ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস থিংক ট্যাংক’ এর মতে, ২০১৬ সালে সাতটি দেশে ২৬ হাজার বোমা হামলা করে ইউএস বাহিনী— মানে প্রতি ঘণ্টায় তিনটি করে বোমা।

নোবেল কমিটির সাবেক সেক্রেটারি গাইর লুন্ডেস্টাড এএফপিকে বলেছেন, ওবামাকে ঘিরে যে প্রত্যাশা ছিল, তা ‘সম্পূর্ণ অবাস্তব’ প্রমাণিত হয়েছে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি করায় ১৯৭৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার ভাগাভাগি করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও উত্তর ভিয়েতনামি নেতা লি ডুক থো। কিন্তু সেই শান্তি স্থায়ী হয়নি। দুই বছর পর দক্ষিণ ভিয়েতনামে চূড়ান্ত হামলা করা লি ডুক থো নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক ফিরিয়ে দেন। কিসিঞ্জারও তার নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তার সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি মানবাধিকার রক্ষার জন্য যতটুকু প্রশংসা পেয়েছে, তার চেয়ে ঘৃণাই বেশি পেয়েছে।

কিসিঞ্জারকে নিয়ে নরওয়ের ইতিহাসবিদ ও নোবেল বিশেষজ্ঞ অ্যাসলে সভেন বলেন, তিনি কেবল ভিয়েতনামেই যুদ্ধ চালিয়েছেন তা-ই নয়, তিনি পূর্ব তিমুরে হামলার জন্য ইন্দোনেশিয়াকেও সবুজসংকেত দিয়েছেন।

এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকজন স্বৈরশাসকের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও কিসিঞ্জার ভূমিকা রেখেছেন।

নোবেল ও গণহত্যা

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় ১৯৭৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। যদিও সভেনের মতে, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বেগিনের হাত। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে লেবাননে আক্রমণ করে বৈরুত দখল করে নেয়ার অনুমতি দেন বেগিন এবং এটাই পরোক্ষভাবে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।

আরো কিছু নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ীরা যুদ্ধ ও গণহত্যার মতো অপরাধে জড়িয়ে কলঙ্কিত হয়েছেন। এ তালিকায় অন্যতম অং সান সু চি। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার কারণে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, হত্যা করা হয় বহু মানুষকে। একে জাতিসংঘ গণহত্যা আখ্যা দিলেও সু চি এখানে নির্বিকার। ফলে ১৯৯১ সালে পাওয়া তার নোবেল শান্তি পুরস্কারটি কেড়ে নেয়ার দাবি উঠেছে।

যুদ্ধে জয়লাভ করলেও আবিই আহমেদের গৌরব আর জ্যোতি এখন কলঙ্কিত

সম্প্রতি টাইগ্রেতে আনুষ্ঠানিকভাবে গুলি আর বোমার গর্জন থেমেছে।উত্তরাঞ্চলে তিন সপ্তাহের লড়াই শেষে ২৮ নভেম্বর বিজয়ের ঘোষণা দেন ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী আবিই আহমেদ। টাইগ্রেতে এ যুদ্ধে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তা জানা যায়নি, যদিও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলছে, অন্তত কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। টাইগ্রে থেকে দলে দলে বেসামরিক মানুষজন পার্শ্ববর্তী সুদানে পালিয়ে গেছে এবং এরই মধ্যে জাতিসংঘ বড় ধরনের মানবিক সংকটের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছে।

ফলে যুদ্ধে জয়লাভ করলেও আবিই আহমেদের গৌরব আর জ্যোতি এখন কলঙ্কিত।

১১ নভেম্বর দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, চলমান সংঘর্ষে ভুল কিংবা সঠিক যাই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত যে একজন শান্তিকামী হিসেবে তার সুনাম গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা নোবেল কমিটির জন্যও একটা শিক্ষা। যখন সন্দেহ পোষণ করবেন, অপেক্ষা করুন।

অতীতেও আরো কয়েকবার নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার আগে ধৈর্য ধরে আরেকটু ভাবা যেত বলে মনে করিয়ে দিলেন ইতিহাসবিদরা।

নোবেল পুরস্কারের বিধিতে আসলে এসব কোনোভাবেই যায় না। আবার নোবেল শান্তি বিজয়ী কোনো দেশ কিংবা ব্যক্তির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করার নীতি থেকেও বিরত থাকে পুরস্কার কমিটি। কিন্তু এ প্রথম প্রথা ভাঙল নোবেল কমিটি। ১৬ নভেম্বর দেয়া এক বিবৃতিতে তারা ইথিওপিয়ায় সাম্প্রতিক সংঘর্ষ নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে। যদিও এরপর ২০১৯ সালে আবিই আহমেদকে পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থনই করছে কমিটি।

সূত্র: এএফপি 

ইজে

পূর্ববর্তি সংবাদফের কানাডায় হত্যাকারী দল পাঠানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেন সৌদি যুবরাজ
পরবর্তি সংবাদইমরানকে হটাতে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা পাকিস্তানের বিরোধী জোটের