ভারতের দমন-পীড়ন: মানসিক চাপে হৃদরোগে মৃত্যু বাড়ছে কাশ্মীরিদের

মুরতাজা শিবলী।।

আল্লাহ তাআলা রউফ তাহের ভাইয়ের আখেরাতের সফর সহজ করে দিন। তাকে হারানোর ব্যথা এখনো তাজা এর মধ্যেই সিমানার ওপার- কাশ্মীর থেকে খবর এসেছে আরেক দোস্ত নিয়াজ আহমদ হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে ইন্তেকাল করেছেন।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট দখলদার ভারত সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর থেকে সাধারণ কাশ্মীরিরা সীমাহীন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

দেড় বছর ধরে কাশ্মীরিদের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে অ-কাশ্মীরি অফিসারদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছে ভারতের দখলদার সরকার। যারা কাশ্মিরের স্থানীয় প্রশাসনিক বিষয়গুলিও ভারতের  পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। যে কারণে প্রতিনিয়ত কাশ্মীরের নাগরিকরা নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

যেমন, এই শীতে এখন পর্যন্ত কয়েকবার প্রবল তুষারপাত হয়েছে কাশ্মীরে, কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে  রাস্তা ও বিভিন্ন এলাকার গলি থেকে বরফ হয়তো অনেক দেরিতে সরানো হয়েছে অথবা একেবারেই সরানো হয়নি। এতে সাধারণ কাশ্মীরিদের চলাচলে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

শীত মৌসুমে ভারি তুষারপাত ও প্রশাসনের দায়িত্বহীনতায় অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কেউ কেউ বলছেন ২০১৯-এর ৫ আগস্টের পর কাশ্মীরিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কারফিউ ও করোনা ভাইরাসের কারণে জারি করা লকডাউনের পর কাশ্মীরে এখন যেন তৃতীয় কোন লকডাউন চলছে।

নিম্ন তাপমাত্রা, বৈরি আবহাওয়া ও তুষারপাতের কারণে রাস্তায় গাড়ি চালানো তো দূরের কথা হেঁটে চলাচল করাও কঠিন হয়ে গেছে। যে কারণে মুমূর্ষূ রোগীদের কাছেও জরুরী সেবা পৌঁছানো যাচ্ছে না। এতে করে কেউ ইন্তেকাল করলে তার দাফন-কাফনের কাজও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও প্রিয়জনকে শেষ মুহূর্তে একবার দেখার সুযোগ হচ্ছে না। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা বুকে চাপা দিয়ে রাখতে হচ্ছে কাশ্মীরিদের।

সদ্য প্রয়াত আমার বন্ধু নিয়াজ আহমাদ একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। মরহুমের বাবা উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের জন্য অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন। তিনি তার মা ও তিন ভাইকে নিয়ে এক সাথে থাকতেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার ছিল। কোন ধরণের আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন না নিয়াজ আহমাদ। তারপরও ৪৫ বছর বয়সী নিয়াজ আহমাদের হৃদযন্ত্র হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে  দিল।

যেকোন অবস্থায় মানুষের মৃত্যু নির্ধারিত –সেদিক বিবেচনায় এই মৃত্যু স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরে দিনদিন এমন মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।

চলতি মাসের (জানুয়ারি) প্রথম ১৮ দিনেই ৩০-এর অধিক কাশ্মীরি যুবক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন- অবস্থা কতটা শোচনীয় তা এই সমীক্ষার দিকে নজর দিলেই বুঝে আসে।

২০১৮-এর ৫ আগস্টে ভারতের দখলদার সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর থেকে কাশ্মীরিদের মাঝে নিরাপত্তহীনতা ও অসহায়ত্ববোধ দিনদিন বেড়ে চলেছে।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর সাথে যুক্ত হওয়া নতুন বিধিনিষেধের কারণে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যে পরিমাণ সমস্যা বেড়েছে, তা শব্দে বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

একারণেই কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিক ও যুবক শ্রেণী দিনদিন বিভিন্ন ডিপ্রেশন ও মানসিক চাপে ভুগছেন।

প্রায় এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল আমি কাশ্মিরের বাইরে অবস্থান করছি। কিন্তু সেখানে আমার জানাশোনা এক ডজনেরও বেশি মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন এই সময়ের মধ্যে। যাদের অধিকাংশই ছিল যুবক।

এদের মধ্যে আলীগড় ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আমার এক নিকটাত্মীয়ের ভাতিজি ও একজন শিক্ষকও ছিলেন। এছাড়াও আমাদের প্রতিবেশি এক নববধূর স্বামীও রয়েছেন। যাদের বিয়ের মাত্র দু সপ্তাহ পার হয়েছে।

কাশ্মীরে কর্মরত চিকিৎসকদের মতে, গত দুই বছরে কাশ্মীরি যুবকদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। কাশ্মিরে হার্ট এ্যাটাকে মৃতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ হতে পারে বলেও কিছু কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ভারতের নানামাত্রিক বিধি-নিষেধ ও জুলুমের কারণে ডিপ্রেশন এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত এক জায়গায় বন্দী থাকাকে কাশ্মিরীদের হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ বলে মত বিশ্লেষকদের।

দীর্ঘ দিনের কারফিউ এবং দমন পীড়নের কারণে কাশ্মিরীদের নিজেদের ঘর-বাড়ি ও এলাকায় বন্দী জীবন পার করতে হচ্ছে প্রায় দুবছর ধরে।

দিনদিন ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ কেড়ে নিয়েছে কাশ্মিরীদের হাসি-খুশি স্বাভাবিক জীবন। একারণেই কাশ্মীরিদের মাঝে নানারকম ডিপ্রেশন দেখা দিচ্ছে, সাথে বেড়ে চলেছে হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যু। যেমনটা আমার বন্ধু নিয়াজ আহমদের সাথে ঘটল। আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিন ও তার পরকালের সফর সহজ করে দিন।

সর্বশেষ গেন্ডারব্যাল এলাকার আবদুল সামাদ খান্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। তার লাশ বাড়িতে পৌঁছালে তার ছোট বোন রাজা বানু সেই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা কাশ্মীরিদের জীবন সহজ করুন।

ডেইলি জং অবলম্বনে নুরুদ্দীন তাসলিম।

-আরএম

পূর্ববর্তি সংবাদপ্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ওসিকে থানায় বোমা মারতে বললেন এমপি! (ফোনালাপের অডিওসহ)
পরবর্তি সংবাদআজ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম লাহোর, দ্বিতীয় ঢাকা, তৃতীয় দিল্লি