ভাষার কি নিজস্ব কোন ধর্মপরিচয় আছে? আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি সকল ভাষা যাবতীয় ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। সকল ভাষাই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আলকুরআনে- তোমাদের ভাষা ও গাত্রবর্ণের বৈচিত্র্যও আল্লাহর তাআলার অন্যতম নিদর্শন। (সূরা রূম, আয়াত-২২) তবে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে- আমি প্রত্যেক রাসূলকে স্বজাতির ভাষাজ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছি। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-৪) এখন প্রশ্ন হল, বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাংলাভাষা প্রসঙ্গে যে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা হয় তার বাস্তবতা কতটুকু?! আমরা কয়েকটি ধাপে এই প্রসঙ্গটি আলোকপাত করতে চাই- ক. সকল ভাষা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি; কিন্তু কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে শুধু আরবী ভাষায়। নাযিল হয়েছে বিশ্ব মুসলিমের জন্য, নিছক আরব মুসলিমের জন্য নয়। সুতরাং আরবী হল বিশ্ব মুসলিমের আন্তঃধর্মীয় ভাষা। (আরবীকে এখানে মুসলিমদের নিজস্ব ভাষা দাবি করা হয়নি। কারণ ইসলামপূর্ব কাল থেকেই আরবীভাষা বিদ্যমান এবং অনেক আরবীভাষী ইয়াহুদি-খ্রিস্টান আছে।) সুতরাং ধর্মীয় কারণে আরবীর সাথে মুসলিমদের আত্মার বন্ধন থাকাটাই যৌক্তিক। এখানে সাম্প্রদায়িকতা খুঁজতে যাওয়া বুদ্ধির অপব্যবহার।
খ. ভাষার আরেকটি রূপ হল পরিভাষা। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব কিছু শব্দ আছে, যা নির্ণীত ও নির্ধারিত হয় কখনও ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মপ্রণেতা কর্তৃক, কখনো বা ধর্মানুসারীদের বহুল ব্যবহারের দ্বারা। এক্ষেত্রে অপর ভাষার প্রতিশব্দ ব্যবহার চলে না। যেমন- আল্লাহর পরিবর্তে ঈশ্বর, নবীর পরিবর্তে দেবদূত, ইবাদাতের পরিবর্তে উপাসনা, বোঝানোর জন্য বলা যেতে পারে কিন্তু ব্যবহার করা যায় না। এটা হল পরিভাষা, সাম্প্রদায়িকতা নয়। সুতরাং উপবাস/রোযার পরিবর্তে সউম বললে সাম্প্রদায়িকতা বা ‘তথাকথিত’ মৌলবাদ খুঁজতে যাওয়া বোকামি। (কোন ভুল যুগ-যুগ ধরে চলে আসাটা তার শুদ্ধতার দলীল নয়। তবে ‘রোযা’র পরিবর্তে ‘সউম’-এর চর্চা এবং ‘নামায’-এর পরিবর্তে ‘সালাত’-এর ব্যবহার, ভুল থেকে মূলের দিকে ফেরা, সুতরাং একঅর্থে এটাও মৌলবাদ।)
গ. ইসলামকে একটি ধর্ম বলা হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে এটিকে শুধু দীন বলা উচিত, ধর্ম নয়। কারণ ‘ধর্ম’ কখনও ‘দীনের’ যথার্থ প্রতিশব্দ হতে পারে না। ‘দীন’ হল ‘ধর্ম’ থেকে আরও বৃহৎ ও মহৎ কিছু। যার রয়েছে (স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে) সর্বব্যাপ্তি, রয়েছে স্বকীয়তা ও নিজস্ব সংস্কৃতি। বর্তমান সকল ধর্মেই এই বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। সেই স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের দাবি থেকেই ইসলাম তার অনুসারীদের নির্দেশ দেয় যেন তারা অন্যান্য ধর্মের সাদৃশ্য বর্জন করে। ধর্মের সেই নির্দেশ মেনে মুসলিমগণ আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান ইত্যাদি নাম রাখেন, ঈশ্বরচন্দ্র দাস বা এজাতীয় কোন নাম রাখেন না, যেখানে বিধর্মী সাদৃশ্য বিদ্যমান। সুতরাং এটাও ভাষাগত কোন সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। এখানে কেউ হয়ত ‘জল-পানি, গোশত-মাংস’ জাতীয় বিতর্ক টেনে আনতে চাইবেন। আসলে এখানে বিতর্কের কিছুই নেই। কারণ যিনি পানি বা গোশতের পক্ষে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তিনিও কিন্তু জল-মাংশের দ্বারস্থ হন। তিনিও ব্যবহার করেন-“জলবায়ু, জলাধার, জলদ; মাংসল, মাংসাশী, মাংসপেশি”। আদপে ‘পানি বা গোশত’ কোনটিই আরবী শব্দ নয়। তারপরও যদি দিল কবুল না করে তাহলে বলব, বাঙ্গালী মুসলিমদের জন্য ফারাক্কা-তিস্তার ‘জল’ ছেড়ে দিলে, বাংলাদেশের হোটেলগুলোতে “নো বিফ” প্রচারণা বন্ধ করলে এবং ভারতীয় মুসলিমদেরকে ‘গোমাংশ’ খাওয়ার অবাধ সুযোগ দিলে, আজ থেকেই আমরা ‘পানি-গোশত’ ছেড়ে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হয়ে যাব।
বিষয়টা যেহেতু সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই, তাহলে এমন প্রশ্ন ওঠাও তো স্বাভাবিক যে, কখনও শুনেছেন, কেউ ‘ঈশ্বরে’র পরিবর্তে ‘আল্লাহ’ বলছেন, সন্তানের নাম ‘দিলিপ কুমার’-এর পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ ইউসুফ খান’ রেখেছেন?! নাকি এখানে এসে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ নিজেই ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে যায়?!!
-আরএম