নতুন নির্বাচনী ‘সংস্কৃতি’: মেয়রপ্রার্থীকে এসপি কেন মন্ত্রীর কাছে ধরে নিয়ে যাবে!

শরীফ মুহাম্মদ ।।

বাংলাদেশের জন্য খবরটি হয়তো এখন আর বিস্ময়কর নয়। কারণ ক্ষমতার প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগের নানা রকম চিত্র গণমাধ্যমের ফাঁক ফোকর ধরে সামনে চলে আসছে। কখনো বিদেশি গণমাধ্যমে, কখনো দেশি গণমাধ্যমে। গত কয়েকদিন আগে যশোরের এক এমপি প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই খবর ব্যাপকভাবে চাউর হলেও বিশেষ কোনো বিচার আচারের খবর পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যেই আজকে বাংলাদেশের প্রভাবশালী সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে শিরোনাম হলো: ‘কালকিনির স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর দাবি, এসপি গাড়িতে উঠিয়ে ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিয়ে যান’।

রোববার (আজ) দুপুর পৌনে দুইটায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মসিউর রহমান ওরফে সবুজ অভিযোগ করেছেন, পুলিশ সুপারের (এসপি) গাড়িতে উঠিয়ে তাকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নিখোঁজের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর আজ রোববার এলাকায় ফিরে তিনি এমন কথা বলেন’।

‘এর আগে গতকাল শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সরকারি গাড়িতে ওঠার পরই নিখোঁজ হন সবুজ। নিখোঁজের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর আজ রোববার ভোররাত পৌনে চারটার দিকে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন’।

এদিকে আজ সকাল ১০টায় জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন অন্য কথা। মুঠোফোনে তিনি দাবি করেন, ‘সবুজ নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট কাজে আমার অফিসে আসেন। পরে তিনি ঢাকায় যান তাঁর ব্যক্তিগত কাজে। আমরা তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার সময় সহযোগিতা করেছি।’

আর মেয়র প্রার্থী সবুজ স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ করেন, ‘আমাকে বিকেলে হঠাৎ এসপি ফোন করে দেখা করতে বলেন। তিনি থানার ওসিকে আমার কাছে পাঠান। তখন আমি ওসির কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে এসপি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। পরে আমি সরল মনে তাঁর গাড়িতে উঠে এসপির অফিসে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এসপি আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে যান।’

প্রকাশিত খবরে আরও দেখা যায়, সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করেন‘এসপি আপনাকে ঢাকায় কেন নিলেন?’—এমন প্রশ্নের জবাবে সবুজ দাবি করেন, ‘এসপি আমাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিয়ে যান। সেখানে ওবায়দুল কাদের আমাকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দল যাকে প্রার্থী নির্বাচন করেছে (আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম হানিফ), তাঁর পক্ষে কাজ করার জন্য বলেন। আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান।’

গণমাধ্যমের কাছে মেয়র প্রার্থী সবুজের দাবি, ‘গতকাল (শনিবার) রাত আটটার দিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্ধারিত কক্ষে তার সঙ্গে সরাসরি কথা হয়। প্রায় ৩৫ মিনিট তাদের মধ্যে কথা হয়।

খবরের এতোটুকু জনসমক্ষে আসার পর একই সঙ্গে এ বিরক্তি ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনের নামে তামাশা হতে আর কত বাকি আছে দেশে! সরকারি দলের মনোনীত না হওয়ায় একজন মেয়রপ্রার্থীকে স্থানীয় এসপি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন। এরপর ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার পর সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী তার সঙ্গে দরবার করবেন। (আপনি এখানে হুমকি-ধমকি শব্দ ব্যবহার করতে পারেন!) নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীর জন্য তাকে কাজ করতে বলবেন। এটা কত বড় জঘন্য রকম চাপ সৃষ্টির ঘটনা! নির্বাচনের সঙ্গে এ ধরনের ‘চাপ- হুমকি- স্যাবোটাজ’-এর সম্পর্ক আসলে কতটুকু? নাকি এখন নির্বাচন করার পদ্ধতি এটাই?

অবশ্য তুলে নিয়ে যাওয়া এই মেয়রপ্রার্থীর মনের অবস্থাটা বেশ মজবুত। প্রশাসনের মাঝারি ও উঁচু পর্যায় থেকে এই পর্যায়ের চাপ সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেশ অনড়। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সবুজ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। আমি কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলাম। আমি দলের কাছে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়নও চাইনি। আমি জনগণের হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছি। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুরোধে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব না। আমি নির্বাচন করব এবং শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’

মেয়র প্রার্থী সবুজ সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘এসপি আমাকে এভাবে গাড়িতে তুলে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ঠিক করেনি। তিনি সবকিছু সত্য বলে আমাকে ঢাকায় নিতে পারতেন। তাহলে আর এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত না। এসপি আমাকে ঢাকায় ওবায়দুল কাদেরের কাছে ছেড়ে চলে যান। আমি দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা শেষ করে আমার এলাকার এক বড় ভাইয়ের গাড়িতে ঢাকা থেকে কালকিনি আসি।’

এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে খবর প্রকাশ করে দৈনিক প্রথম আলো জানায়, পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর সবুজ নিখোঁজের সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে তার সমর্থকেরা গতকাল সন্ধ্যা থেকে থানার সামনে অবস্থান নেন। পরে বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা। একপর্যায়ে নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে সবুজের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। টানা তিন ঘণ্টার সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হন। এ সময় দুই পক্ষের লোকজনের হাতে লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র দেখা যায়। সংঘর্ষের সময় ককটেল বিস্ফারণ ও গুলির শব্দও শোনা গেছে। সংঘর্ষে সময় শতাধিক দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন কমপক্ষে ৬০ জন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত একজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

নির্বাচনে কারচুপি, প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি, আগের রাতে নির্বাচন সেরে ফেলা- এসব গল্প এবং খবর পড়তে পড়তে আমরা যখন কিছুটা ক্লান্ত, তখন নতুন খবর এলো, জেলা পর্যায়ের পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধের প্রার্থীকে উঠিয়ে নিয়ে ঢাকায় মন্ত্রীর সঙ্গে দরবার করিয়ে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে; অন্তত প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে প্রার্থী এই অভিযোগ করেছেন।

-এনটি

পূর্ববর্তি সংবাদধানমন্ডিতে দোকানের তালা না ভেঙেই ৪০০ ভরি স্বর্ণ লুট!
পরবর্তি সংবাদকরোনা: একদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫৩১ জন, মৃত্যু ১৫