শরীফ মুহাম্মদ ।।
মৃত্যুর পর কবর বা সমাধির ভূমিকাটা কী? মৃত ব্যক্তির কবর, কবরের চাকচিক্য, শান-শওকত বেশি হলে মৃতব্যক্তির কি কোনো উপকার হয়? নাকি জীবদ্দশায় নিজের করা নেক আমল এবং মৃত্যুর পর জীবিত উত্তরাধিকারীদের ‘পাঠানো’ সওয়াব তার কাজে লাগে?
মুসলমান মাত্রই এর উত্তর জানেন। মৃত মুসলমানকে কবরস্থ করা ইসলামের বিধান। কবরকে সাদামাটা রাখা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অসম্মান না করা এটাও ইসলামী শরীয়তের প্রেরণা ও আদাব। মাঝে মাঝে কবর জিয়ারত করা এবং সে সময় কবরস্থ ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা সুন্নত। কিন্তু এরপরও কোনো মানুষ মারা যাওয়ার পর ‘কাজে লাগার মতো’ কাজগুলো বাদ দিয়ে শুধু কবরের শান-শওকত বৃদ্ধির চেষ্টাটাকে আপনি কী বলবেন? মরার পরেও নাম-মান জারি রাখার চেষ্টা? মৃত্যুর পর শুরু হয়ে যাওয়া অনন্ত জীবনের সফরে এই দুনিয়ার জীবনের চিহ্নটাকে বড় করে রাখার এক ব্যর্থ কসরত? পৃথিবী ও ইহকালীন জীবন ও খ্যাতির প্রতি এক ধরনের বাড়তি মোহ ও মায়া?
হতে পারে অনেক কিছুই। এবং একই সঙ্গে এটাও একটা লক্ষণীয় ব্যাপার যে, জীবনকালের সঙ্গে জান্নাত কিংবা জান্নাতের সুসংবাদের কোনো সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, অথবা মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনকালের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কোনো অনুভূতি আদৌ না থাকুক-দেখা যায় কবর বা সমাধির সৌন্দর্য-আয়োজন নিয়ে মৃত্যুর আগেই কিছু মানুষ নানা রকম ব্যস্ততায় সময় পার করে! এর উদাহরণ অনেক, দূর ইতিহাসে এবং কাছের দিনগুলোতেও। সম্প্রতি প্রভাবশালী একটি জাতীয় দৈনিকে এমনই একটি প্রতিবেদন চোখে পড়লো। একদিকে ঢাক-ঢোল, আরেকদিকে আফসোসের ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে রচনা করা হলো না-হওয়া এক সমাধি সৌধের শোকগাথা। প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘সৈয়দ হকের সমাধি অবহেলায়, দায় কার’?
প্রতিবেদনের মুখবন্ধ বা ইন্ট্রোর শুরুর দিকেই বলা হলো,”সৈয়দ শামসুল হক মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। যা সৈয়দ শামসুল হক স্মারকগ্রন্থ ‘ফুলের গন্ধের মতো রয়ে যাব’-তে ‘জলেশ্বরীর ভূমিপুত্র’ শিরোনামের লেখায় তার বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।”
প্রফুল্ল চিত্তে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণের বর্ণনাটা দেওয়া হলো এই ভাবে- ‘সৈয়দ শামসুল হক নিজের সমাধিস্থান নিজে নির্বাচন করে গেছেন। কবরের এপিটাফও লিখে গেছেন নিজেই। তিনি সমাধিসৌধের ডিজাইন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনকে। তিনি বেঁচে থাকতে তাকে সমাধিস্থানটি দেখাতে সঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তার মৃত্যুর পর রবিউল হুসাইন কুড়িগ্রামে একাধিকবার সমাধিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য এসেছিলেন। তার সমাধিস্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসেন ও সংস্কৃতিসচিব ইব্রাহিম খান। এসেছিলেন কবি তারিক সুজাত’।
২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক আরো দাবি করলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি খসড়া প্রকল্প তৈরি করেছে, যার মধ্যে জলেশ্বরী কমপ্লেক্স ও সমাধিসৌধ পাশাপাশি রয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি মিলনায়তন, গবেষণাকেন্দ্র, পাঠাগার, অফিস, মুক্তমঞ্চসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। প্রকল্পটি যাতে দ্রুত হয়, সে জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল নকশা প্রণয়ন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে জমি হস্তান্তর করা। জমির জটিলতা যাতে না হয়, সে জন্য সেই সময় শিক্ষাসচিব ও সংস্কৃতিসচিব মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন। তাঁরা সম্মতিও দিয়ে গেছেন।”
“জানি না আজকে জলেশ্বরী কমপ্লেক্সের কত দূর এগোল। কোন সুতোর ফাইলে এটি বন্দী আছে। এরই মধ্যে কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন এ প্রকল্প কবে বাস্তবের মুখ দেখবে জানি না।”
প্রায় দেড় মাস আগের স্মৃতি উদ্ধৃত করে প্রতিবেদক আক্ষেপের রেশ ছড়িয়ে দেন, “গত ২৭ ডিসেম্বর সৈয়দ শামসুল হকের পত্নী আনোয়ারা সৈয়দ হক (যিনি নিজেও এ দেশের খ্যাতিমান মানুষ, যাঁর বয়সও আজ ৮০ বছরের ওপরে) প্রয়াত সব্যসাচীর লেখা নিজ কবরের জন্য প্রণীত এপিটাফটি আমাকে পাঠানোর সময় কষ্ট নিয়ে বলেছেন,… আমারও যাবার পালা হলো, বেঁচে থাকতে থাকতে যদি সমাধিসৌধ ও জলেশ্বরী কমপ্লেক্সটির পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন দেখতে পেতাম, তা হতো আমার জন্য আনন্দের। মরে গেলে ওপারে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে যদি দেখা হয়, তাঁকে বলতে পারতাম, এ দেশের মানুষ এখনো তাঁকে ভালোবাসে।”
প্রিয় পাঠক, পরকালের জন্য যা দরকার, যেই যেই আমল ও নেক কাজ করলে মৃত ব্যক্তির উপকার হবে (যদি মৃত ব্যক্তি ন্যূনতম ঈমানের অধিকারী হয়), তা বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির সমাধিকে ঘিরে নানা রকম কমপ্লেক্স গড়ে তোলা, সমাধি পরিচর্যা করার মধ্যেই জীবনের ‘মহাসাফল্য’ খুঁজে পাওয়ার সাথে দ্বীন ও ঈমানী জিন্দেগীর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং অনেকক্ষেত্রে কবর ও সমাধি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম সৌন্দর্য ও সৌধ নির্মাণ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু যারা দুনিয়ার জীবনে দ্বীনি অনুশাসন ও মূল্যবোধের কোনো মূল্যই দেয় না, মৃত্যুর পর অনন্ত জীবনের পাথেয় যোগানের পরিবর্তে ইট সুড়কি রড পাথরের মায়া- মোহ তাদের অতিক্রম করতে পারার কথা না। এটা শুধু প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক ও তার জীবিত স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক-এর মনের আকুতির বিষয় না, বহু বহু দ্বীন-ভোলা মানুষেরই মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এ ধরনের ‘সমাধি বিলাস’ দেখা যায়। সমাধির এই আড়ম্বর যে জাহান্নামের আগুন এবং ধিক্কার থেকে মানুষকে মোটেও রক্ষা করতে পারবে না, এটা যেন কারো মনেই থাকে না। এই মনে না থাকাটা বড়ই বেদনার, বড়ই আক্ষেপের!
এতো গেল মৃত্যুপরবর্তী ‘সম্মান- শ্রদ্ধার’ প্রতীকী আয়োজনের এক ধরনের প্রস্তুতি। এর উল্টো চিত্রও আছে সমাজে। এই করোনাকালে মৃত্যুবরণ করা দেশের প্রথম সারির এক শিল্পপতির কবরের ছবি কয়েকদিন আগে দেখলাম, সামাজিক মাধ্যমে। মনে হলো না, হাজার হাজার কোটি টাকা রেখে যাওয়া ওই মানুষটির বংশধরেরা চলে যাওয়া অভিভাবকের কবর ‘জিয়ারতের’ সুযোগ-সময় পান। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচটি মিনিট দোয়া-দরুদ, তেলাওয়াতের প্রয়োজন অনুভব করেন। মনে হলো, লোকটি মরেও গেল, চলেও গেল, মুছেও গেল; বিত্তবান উত্তরাধিকারীদের কাছে তার জন্য আর কোনো ‘সময়’ই রইলো না। এই চিত্রটাও মনের কোণে অন্যভাবে বেদনা জাগিয়ে যায়। অথচ এর কোনোটাই হওয়া উচিত ছিল না। জীবদ্দশায় নেক আমল এবং মৃত্যুর পর নেক কাজে তাদের জন্য খরচ, তাদের জন্য ‘সওয়াব পাঠানো’ এই আমলগুলো জারি থাকাটাই বেশি দরকার ছিল। এবং এখনো প্রতিটি মানুষের জন্য দরকার।
সমাধির আড়ম্বর, সমাধির সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিচর্যার আগে প্রয়োজন জীবনের ঈমানদীপ্ত পরিচর্যা। যার ঈমানের ঠিক নেই তার সমাধির পেছনে ১০০ কোটি টাকা খরচ হলেই বা কী লাভ! ঈমানের সঙ্গে যার নেক আমলের পুঁজি নেই, লাখ লাখ টাকা দিয়ে তার সমাধির ইট-সুড়কি বাড়ালেই কী ফায়দা? অপরদিকে প্রয়াত যে অভিভাবক পরবর্তী প্রজন্মকে বিত্তবৈভবে রেখে গিয়েছেন, তার কবরের সামনে অথবা আড়ালে তার জন্য পাঁচটি মিনিট দোয়া করতে না পারা, তার রেখে যাওয়া অর্থ থেকে ‘উপকারী’ খাতে খরচ করতে না পারার চেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং অকৃতজ্ঞতা আর কী হতে পারে! অতএব জীবনে ঈমান ও নেক আমল এবং মৃত্যুর পর দোয়া ও নেক কাজে খরচ করে সওয়াব পাঠানোর প্রচেষ্টাই হোক মুমিনের প্রধান পথচলা।
এই দুনিয়ায় বহু আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্বের কোনো সমাধিই হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে সমাধির কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। ঈমান ও নেক আমলের সৌধই অনন্ত পরকালে তাদের জন্য অনেক অনেক বড় প্রাপ্তির দিগন্ত খুলে রেখেছে।
-এনটি
