দুই সপ্তাহের করুণা, দুই হাজার বছরের স্বপ্নসাধ

শরীফ মুহাম্মদ ।।  

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার সহযোগিতা না থাকলে সৌদি আরবের শাসক গোষ্ঠি দুই সপ্তাহও টিকতে পারবে না। তার এ জাতীয় মন্তব্য একদমই নতুন নয়। চমকে দেওয়া, মুখ ফসকানো কথা তার অভ্যাস। হঠাৎ হঠাৎ বিশ্বমোড়লদের কেউ কেউ প্রগলভ হয়ে উঠেন। এমন সব শব্দ মুখের পিচ্ছিল বারান্দা বেয়ে বের হয়ে আসে যে তাতে পেছনের ঘটনা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এমনিতে তো শান্তি ও প্রগতির কথা, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের কথা মোড়লেরা খুব বলেন। পেছনের কালো বাস্তবতা তাতে সহজে প্রকাশ পায় না। তাদের কথা থাকে শান্তির প্রলেপ মাখা। তবে কখনো কখনো মুখ ফসকেই বেরিয়ে আসে অন্ধকার বাস্তবতা। এটি হয়তো এমনি একটি ঘটনা।

২ অক্টোবর মিসিসিপির এক সম্মেলনে উল্লিখিত মন্তব্য করেন মি. ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার এ বক্তব্য ফলাও হয়ে প্রচার হয়। ট্রাম্প সাহেবের এ বক্তব্যে কয়েকটি বিষয় খুব জোরালো ভাবেই ফুটে উঠেছে। একটি বিষয় হলো, তাদের সহযোগিতা ও করুণায় একটি দেশের সরকার টিকে আছে এমন তথ্য প্রকাশে তাদের মধ্যে কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই। সংশ্লিষ্ট দেশটির অপমান নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের থাকে না মোটেই।

দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশের অগ্রহণযোগ্য শাসকরা যে অমুসলিম শোষক মোড়লদের সঙ্গে প্রশ্নবোধক ও নির্লজ্জ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন এবং তাদের সহযোগিতায় মসনদে টিকে থাকছেন তাও স্পষ্ট হলো এ বক্তব্যটিতে। বক্তব্যটির জেরে তার পূর্বের কিছু অবস্থানও নতুন করে মানুষের সামনে এসেছে। খবর হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব খর্ব করার জন্য সৌদি আরবকে সহযোগিতা করছে আমেরিকা। তারা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার জন্য সৌদি আরবের প্রভাবকে ব্যবহার করছে। যেন সৌদি আরব যেকোনো মূল্যে ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে ইসরাইলের স্বার্থঘেষা শান্তি চুক্তি মেনে নিতে। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান – পশ্চিমা গণমাধ্যম বড় আহলাদ করে বলে এমবিএস – এ চুক্তি মেনে নিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে প্রচণ্ড রকম চাপ প্রয়োগ করেছেন বলেও মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে।

islamtimes24.com
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান

অবশ্য ট্রাম্পের জন্য এজাতীয় বক্তব্য কিন্তু পুরোপুরি নতুন নয়। গত মার্চে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন তিনি মজার কিছু শব্দ ব্যবহার করেন। প্রেসিডেন্টের ভাষায় তখন একটি বড় দেশের শাসকের সুরটাই ছিলো না শুধু, ছিলো লুটেরা ও ডাকাতের স্বরশব্দের প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, সৌদি আরব খুব ধনী রাষ্ট্র। তাদের অঢেল সম্পদ। তাদের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পদ ভাগাভাগি করা। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশেই আছে। ট্রাম্প কোনো রাখ-ঢাক ছাড়াই বলেন, সৌদি আরব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমরাস্ত্র কিনে নেয়ায় বিপুল সংখ্যক মার্কিনিদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। সৌদির সঙ্গে শুধু অস্ত্র কেনাবেচায় ৪০ হাজার মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। হাজার কোটি বিলিয়ন ডলার মার্কিনিদের ঘরে জমা হয়েছে।

ধনী মুসলিম দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বাস্তবতা হয়তো এমনই। উপরে উপরে থাকে শান্তি, প্রগতি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের কথা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চলে সে দেশের সম্পদ লুটের প্রবল বাসনার চাষবাস। সেই লোভী চাষবাসের কথা আবার মুখের জোরে বলেও ফেলে ।

এই পুরো বক্তব্য -ঘটনা থেকে দুটি বিষয় বেশ বড় হয়ে সামনে আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন পর্যায়ের মোড়লরা মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাখ্যায় যাই বলুক না কেন, তাদের ভেতরের দিকটা থাকে লোভাতুর ও কদাকার। সব মুসলিম দেশের কর্তারাই এখান থেকে সতর্ক সবক নিতে পারেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, মুসলিম শাসকদের ব্যক্তিত্ববোধ, লজ্জা, বোধোদয় এতো নিচে নেমে গেছে যে মোড়লরা তাদের প্রতি অনুগ্রহের কথা মাঠেঘাটে বলে বেড়াবে! আর তারপরও তারা মাটি কামড় দিয়ে তাদের দরজাতেই পড়ে থাকবে!! এইসব নির্লজ্জ কাজ করে কি তারা তাদের ক্ষমতা রক্ষা করতে পারবে, নাকি মুসলিম দেশের সম্মান – মর্যাদা রক্ষা হবে ? এর কোনোটাই কি এতে হবে?

সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান

ঘটনা এখানেই শেষ হলে হয়তো ভালোই হতো। কিন্তু না, সৌদি যুবরাজ এমবিএস দমবার পাত্র নন। ট্রাম্পের দু সপ্তাহের করুণা-হুমকির পর এমবিএস গদগদ স্বরে বলেছেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভালোমন্দ যে কোনো কিছুই বলতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গণমাধ্যমকে এমবিএস আরো বলেন, ট্রাম্প যা-ই বলুন, আমি তার সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসি।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পুরোপুরি সঁপে দেয়ার পর সুর একটু উল্টো করে আবার তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই সৌদি আরব দুই হাজার বছর টিকে থাকতে পারবে।’ এ যেন আত্মসমর্ণ ও আনুগত্যের ঝাঁজালো এক শিল্প। অসাড় স্বপ্নসাধ!

সতর্ক হওয়ার সময়। সংযত হওয়ার উপলক্ষ। দুনিয়ার মোড়লদের সঙ্গে মুসলিম শাসকরা যত চড়া মূল্য পরিশোধ করেই সম্পর্ক গড়ুক না কেন, প্রয়োজন ফুরালে শাসকদের ছুড়ে ফেলা, সময়ে-অসময়ে অপমান করার ক্ষেত্রে তারা মোটেও দ্বিধা করে না। এসব করে তারা না পারবেন নিজেদের রক্ষা করতে, না পারবেন দেশের স্বার্থ উদ্ধার করতে। মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশ শাসক -যারা নানান উপায়ে ক্ষমতাসীন, মসনদে আসীন – ক্ষমতা রক্ষার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তির কদমবুছির আমল চালিয়ে যাচ্ছে । এ আমল থেকে তারা কি আর ফিরে আসবেন? তাদের কি হুশ হবে? হুশ হলেই বাঁচোয়া। না হলে উপায় নেই। না বাঁচবে তাদের জান , না হবে দেশের কল্যাণ। #

অনুলিখন : আতাউর রহমান খসরু

পূর্ববর্তি সংবাদহজের বাইরে হজক্যাম্প
পরবর্তি সংবাদফিলিস্তিন সংগ্রামের নতুন প্রতীক আহেদ তামিমিকে সম্মান জানাল রিয়াল মাদ্রিদ