তরুণরাই সময়ের সারথী। আগামীর নির্মাতা। তারুণ্যই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একটি দেশের ভবিষ্যত দেখা যায় তরুণদের চোখে। আর যখন হন তারা হন আলেম, জাতির ভবিষ্যত কাণ্ডারী, তখন তরুণরা হয়ে ওঠে আবেগ-ভালোবাসা, আশা-নিরাশার কেন্দ্র। তাদের ঘিরে আবর্তিত হয় অনেক স্বপ্নকথা। তরুণ আলেমদের নিয়ে এমনই কিছু স্বপ্নকথা, আশা-ভালোবাসার কথা বলেছেন মালিবাগ জামিআর সিনিয়র মুহাদ্দিস ও গবেষক আলেম মাওলানা আবূ সাবের আবদুল্লাহ।
ইসলাম টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে মুখকলামের জন্য যোগাযোগ করলে তিনি নিম্নের বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তব্যকে লেখ্যরূপ দিয়েছেন আবরার আবদুল্লাহ।
পাঠাভ্যাস আলেম পরিচয়ের প্রধান দাবি
পাঠাভ্যাস একজন আলেমের আলেম পরিচয়ের প্রধান দাবি। কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম লেখাপড়া বিমুখ। ছাত্রজীবনেই তরুণদের মধ্যে লেখাপড়ায় অনীহা দেখা যায়। অথচ ভালো আলেম হওয়ার জন্য দরসে নেজামির অন্তর্ভূক্ত বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে পাঠ করা প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষকগণ উৎসাহিত করতেন যেনো আমরা পাঠ্য বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্য বই, তার ভালো ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইত্যাদিও পাঠ করি। এতে আমাদের সময়ের একজন দুর্বল ছাত্রও অনেক বেশি যোগ্য হয়ে উঠতো। আমাদের সময়ের ‘মেহনত’ শব্দটি এখন খানিকটা অপরিচিতই মনে হয়। যদিও ব্যতিক্রম সব সময় ছিলো, এখনও আছে।
আমরা যখন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার শেষভাগে ছিলাম শিক্ষকগণ আমাদের একটি মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। তাহলো, তোমাদেরকে আমরা ইলম নামক সমুদ্রে সাতার কাটা শেখালাম। এখন যে যতোটা সাতার কাটতে ততোটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে। আমাদের তরুণদের বেশির ভাগই সাতার কাটা শিখতেই আগ্রহী না। আর যারা একটু শেখে তারাও জীবন-জীবিকার পেছনে পড়ে তা হারিয়ে ফেলে।
আমি বলবো, তরুণ আলেমগণ যদি জীবন গড়তে চান তবে অধ্যায়নমুখী মানসিকতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা চেষ্টা করবো সপ্তাহে একটি নতুন বই পড়ার, তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোট করার। তারপর যোগ্য ও দরদি কোনো শিক্ষককে তা দেখিয়ে তার পরামর্শ গ্রহণ করার।
কিছু তরুণের ইলমে দীনের গভীরতা অর্জনে অনীহা থাকলেও শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে পাঠের অভ্যাস আছে। পাঠাভ্যাস প্রসংশনীয় তবে যোগ্য কোনো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হওয়া বাঞ্চনীয়। না হলে অনেক সময় উপকারের সময় অপকারই বেশি হয়।
মাদরাসা-মসজিদ বিরাণ করে যেও না
দীনি খেদমতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র তথা মাদরাসা ও মসজিদ আমাদের হাতে আছে। তরুণ মেধাবী আলেমদের দায়িত্ব এ কেন্দ্র দুটি আবাদ করে রাখা। হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. কে হায়দারাবাদের নেজাম প্রস্তাব করেছিলেন দেওবন্দের ছাত্রদের অংক-বিজ্ঞানের মতো আধুনিক বিষয়গুলো আরও বেশি করে পড়ানো হোক। আমরা তাদের চাকরি দেবো। হজরত গাঙ্গুহি রহ. উত্তর দেন, আমরা তো ইচ্ছে করেই তাদের এসব আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে রাখি। যেনো তারা মসজিদ-মাদরাসা কেন্দ্রিক কাজগুলোতে বেশি লিপ্ত থাকে। অন্যত্র যেতে না পারে। তাই তরুণ আলেমদের পেশা মসজিদ-মাদরাসা কেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আধুনিক শিক্ষাবিদদের মতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার মান কমে যাওয়ার কারণ মেধাবী শিক্ষকের অভাব। সমাজে যাদের আর কিছু করার যোগ্যতা নেই তারাই শিক্ষকতা করে। মাদরাসার ক্ষেত্রে এমন যেনো না হয়। মেধাবী ও যোগ্য তরুণ আলেমরা মাদরাসায় অধ্যাপনা করবে এটাই সময়ের দাবি। শিক্ষকযোগ্য না হলে ছাত্র কিভাবে যোগ্য হবে? যোগ্য আলেম তৈরি না হলে জাতির যোগ্য নেতৃত্ব কিভাবে দেয়া সম্ভব হবে? তা অবশ্যই ভাবতে হবে।
একজন আলেমের জন্য জীবিকার গোলাম হয়ে থাকা অনেক বড় মাহরুমি ও লজ্জাস্কার বিষয়। এবং এক প্রকারের অকৃতজ্ঞতা। যদি কেউ কোনো কারণে অন্য কোনো পেশায় যেতে বাধ্য হয় তবে সে যেনো আলেমসূলভ আদর্শ স্থাপন করে এবং মসজিদ-মাদরাসা কেন্দ্রিক খেদমতের সহযোগিতা করবে। সে যেনো তার আলেম পরিচয়টা ভুলে না যায়।
প্রযুক্তি যা দেয়, তার চেয়ে বেশি কেড়ে নেয়
বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। তাই তরুণ প্রজন্মও তথ্য-প্রযুক্তিমুখী। তরুণদের দীর্ঘ সময় কেটে যায় প্রযুক্তির নানান উপকরণের পেছনে। প্রযুক্তির প্রতি তাদের এ আসক্তি নিয়ে আমি শঙ্কিত। প্রযুক্তি জ্ঞানচর্চায়ও অনেক সহায়ক কিন্তু প্রযুক্তির মাধ্যমে যদি আমার আর্থিক উপকার না হয়, আমার দীনী কোনো কল্যাণে না আসে; বরং শুধু বিনোদন ও সময় নষ্টকারী হয় তবে সে প্রযুক্তির পেছনে পড়া আর তিলে তিলে নিজেকে হত্যা করা সমান কথা। তরুণদের সময়ের মূল্য বুঝতে হবে। সময় জীবনের মূল পূঁজি। এ মূলধন হারিয়ে ফেললে জীবনে এগিয়ে অসম্ভব প্রায়।
তরুণ আলেমদের একটি বড় সময় কেটে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। অনেকে সেখানে কু-তর্কেও লিপ্ত হয়। পরস্পরের সম্মাহানিতে মত্ত হয়। এটি অনুচিৎ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আমরা দীন প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।
অনেকেই বলবেন, আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে জ্ঞান আহরণ করতে পারি। আমি বলবো, অবশ্যই পারি। তবে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ পূর্ব শর্ত। আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকলে প্রযুক্তি আমাদের যা দিবে তার চেয়ে অনেক বেশি কেড়ে নিবে। তাছাড়া জ্ঞানগত পরিপক্বতা ছাড়া প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানচর্চা বিপদজনক। কারণ, এখানে অনেক ভুল ও বিকৃত তথ্যও থাকে।
আলেমের হৃদয় বিশ্ব মানচিত্র
আমরা শুধু ভাষাভিত্তিক বা ভৌগলিক জাতীয়তা অন্তরে লালন করি না। আমরা একটু আগ বেড়ে ইসলামি জাতীয়তা লালন করি। এই জাতি যদি আমাদের প্রিয় হয়ে থাকে আমরা যেনো এর প্রতি ভালোবাসা পূরণ করি। তরুণ যদি যার যার জায়গা থেকে আত্মত্যাগ ও কুরবানির শপথ না নেয় তবে আর কে জাতি গঠনে কাজ করবে! সুতরাং আলেমগণ যোগ্য ছাত্র গড়বে, লেখালেখিতে অবদান রাখবে, ওয়াজ-নসিহতে প্রাণ সঞ্চার করবে, সাধারণ মানুষের হেদায়েতের জন্য কাজ করবে। একটি জাতির তরুণদের মতি-গতি দেখেই জাতির ভবিষ্যত বলে দেয়া যায়। আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কার বিষয়ে সতর্ক থাকবে এবং জাতির উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে।
রাজনীতিতে প্রয়োজন মেধাবী আলেম
মানুষের জীবনে রাজনীতির প্রভাব অত্যন্ত প্রখর। পৃথিবীর ক্ষমতা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সামরিক সক্ষমতা ও আর্থিক সামর্থ্য সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির হাতে। জনগণ সাথে থাকে ক্ষমতায় যাওয়ার বুনিয়াদ রচিত হয় ঠিক, তবে বর্তমান সময়ে শুধু জনসমর্থন বা আর্থিক-সামরিক সক্ষমতা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। তার জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা, দক্ষতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। রাজনীতিতে যেসব তরুণ আগ্রহী তারা যেনো এসব বিষয় সামনে অর্জনে মনোযোগী হয়। অপরিণত রাজনীতি জীবনের বেদনার কারণ হয়।
ইসলামি রাজনীতিতে দেখা যায় যেসব ছেলেরা পড়ালেখায় দুর্বল, কিছুটা বখে গেছে তারাই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। অথচ রাজনীতিতে প্রজ্ঞার প্রয়োজন অনেক বেশি। যে পুরো দেশ ও সমাজকে পরিচালিত করবে তার প্রজ্ঞা স্তর তো তেমনই হতে হবে। ইসলামি রাজনীতিতে সফল হতে হলে দুটি বিষয় অপরিহার্য। এক. জ্ঞানগত পরিপক্ষতা, দুই. আত্মশুদ্ধি। এ দুই গুণ অর্জন করতে পারলেই রাজনীতির সুফল উম্মাহ লাভ করবে। আমাদের আকাবিরদের মধ্যে যারা রাজনীতি করেছেন তাদের মধ্যে আমরা এগুণ দুটো খুঁজে পাই। যেমন, হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি রহ., আতহার আলী রহ., হাফেজ্জি হুজুর রহ. প্রমুখ।
আত্মশুদ্ধি ছাড়া আলেম হওয়া যায় না
সবশেষে বলবো, রাসুল সা. কে পৃথিবীতে প্রেরণ করার মৌলিক চারটি উদ্দেশ্যের একটি আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি মুমিনের জন্য ফরজ। আলেমের জন্য তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আলেমরাই জাতির নেতৃত্ব দিবে। তার হৃদয় পবিত্র না হলে জাতি ভুল পথে পরিচালিত হবে। আত্মশুদ্ধি ছাড়া কোনো আলেম আলেম হতে পারে না। আত্মশুদ্ধি না হলে একজন আলেমের দীনি কাজও জাগতিক হয়ে যাবে। আর আত্মা পরিশুদ্ধ থাকলে জাগতিক কাজগুলো ইবাদতে পরিণত হবে।
মাদরাসাগুলো আত্মশুদ্ধির চর্চা কমে যায় তার ভয়াবহ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, আত্মশুদ্ধির অভাব থাকার কারণেই জাতির জন্য আলেমদের নিবেদন দিনদিন কমছে। আমরা বস্তুবাদী হয়ে যাচ্ছি। আকাবিরগণ যেভাবে দীনের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন আমরা তা কল্পনা করতে পারি না এজন্যই। শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফি বলেছেন, প্রতিটি মাদরাসায় যেনো একটি খানকা হয়। তালিম ও তাজকিয়া পাশাপাশি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ছাত্ররা পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী যেকোনো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইসলাহে নফসের কাজ করতে পারে। পিরের মুরিদ হতেই হবে আমি বলবো না। তবে এমন একজন মুরব্বি অবশ্যই প্রয়োজন যিনি ‘তাআল্লুক মাআল্লাহ’ হবেন।