‘আল্লামা তাকি উসমানি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, তুমি আমার মন ভরে দিয়েছো’ -মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন

আল্লামা তাকি উসমানি। সমকালীন ইসলামি বিশ্বের একজন অসামান্য পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। আরব ও বহির্বিশ্বে শায়খুল ইসলাম নামে সমাদৃত। ইসলামি জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি ধারায় তার পদচারণা দেখা যায়। বিশেষত আধুনিক ইসলামি অর্থনীতির উপস্থাপনে তার অবদান অনস্বীকার্য।

আল্লামা তাকি উসমানি একজন ফকিহ, মুহাদ্দিস ও লেখক; সর্বোপরি তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকও। উপমহাদেশের বহু বিদগ্ধ আলেম তার ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। তাদের অন্যতম বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফতি দিলওয়ার হোসাইন। যিনি একাধারে শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানির বিশিষ্ট ছাত্র ও খলিফা। দারুল উলুম করাচিতে শিক্ষকতাও করেছেন কয়েক বছর।

নিজের পীর ও প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে ইসলাম টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন নিজের শিক্ষক ও শিক্ষাজীবনের। উল্লেখ করেছেন চমকপ্রদ একাধিক ঘটনার। কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আতাউর রহমান খসরু


 

ইসলাম টাইমস : শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানির নামের সঙ্গে আপনি প্রথম কবে পরিচিত হন?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আল্লামা তাকি উসমানি (দা.বা.)-এর নামের সাথে আমি প্রথম পরিচিত হই জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় পড়ার সময়। এ সময় হজরতের দরসে তিরমিজি ছেপে এলে তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠি। যদিও ছাত্রজীবনে আমি দরসে শিক্ষকের তাকরির (পাঠদান) নোট করে পড়তাম, শরাহ তেমন কেনা হতো না। দরকার হলে কোনো ছাত্রেরটা দেখে নিতাম।

মুফতি তাকি উসমানি

ইসলাম টাইমস : আপনার পাকিস্তানে পড়ার আগ্রহটা কেন হলো?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আমার একাধিক শিক্ষক আমাকে পাকিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিশেষত মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., মুফতি শামসুল আলম রহ. ও মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ রহ. (মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর)।

এছাড়াও মাআরেফুল কুরআন পড়ার কারণে এবং আল্লামা তাকি উসমানির কারণেও দারুল উলুম করাচির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল।

ইসলাম টাইমস : আল্লামা তাকি উসমানির সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ কীভাবে হয় এবং সেদিনের স্মৃতি কি মনে আছে?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : হজরতের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় দারুল উলুম করাচিতে, আমি যখন ইফতা পড়তে যাই। আমি ভর্তির দরখাস্ত নিয়ে গেলাম। ভিসা প্রসেসিংয়ের কারণে পাকিস্তান যেতে যেতে আমার ভর্তির সময় পার হয়ে যায়। তিনি জিজ্ঞেস করেন, দেরি করলে কেন? আমি কারণ বললাম। হজরত শায়খুল ইসলাম আমার ভর্তি পরীক্ষা নেন। তিনি আমাকে হেদায়ার একটি ইবারতের ব্যাখ্যা করতে বলেন। আমি তার ছয় পৃষ্ঠা ব্যাখ্যা লিখি। সেদিনই তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

ইসলাম টাইমস : সেদিনের অনুভূতি কেমন ছিল?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : সাক্ষাতের আগে খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু সাক্ষাতের পর আর ভয় করেনি। আমি লিখিত পরীক্ষার খাতা জমা দেয়ার পর তিনি আমাকে কিছু মৌখিক প্রশ্ন করেন। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল ইবারাতুন নস ও ইশারাতুন নস (ফিকহশাস্ত্রের দুটি পরিভাষা)-এর মধ্যে পার্থক্য কী? আমি হজরতকে দিয়েই উদাহরণ দিলাম। আমি বলেছিলাম, আমি আপনাকে দেখার জন্য তাকানোর পর আপনাকে যে দেখছি সেটা ইবারাতুন নস আর সাথে সাথে আরও যা দেখছি সেটা ইশারাতুন নস। হজরত আমার উত্তরে খুশি হয়ে গেলেন।

ইসলাম টাইমস : আল্লামা তকি উসমানির কাছে আপনি কী কী কিতাব পড়েছিলেন?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আল্লাহর মেহেরবানি হুজুর আমাদের ব্যাচের যতো ক্লাস নিয়েছেন আর কোনো ব্যাচে এতো ক্লাস নেননি। তিনি আমাদেরকে প্রথমে ইমদাদুল ফাতাওয়ার জায়েজা নিয়েছেন। কে কতটা পড়লাম এবং কতটা বুঝলাম। এরপর পড়ান উসুলুল ইফতা, আশবাহ ওয়ান নাজায়ির এবং নাহজুল ইজতেহাদ। আমাদের তামরিনুল ফাতাওয়াও তিনি করিয়েছিলেন।

ইসলাম টাইমস : শিক্ষক হিসেবে আপনি তাকে কেমন পেয়েছেন?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আল্লাহু আকবার! শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন দৃষ্টান্তবিহীন। একটা ছোট স্মৃতি বলি। হজরত উসুলে ইফতার ইমলা (কথ্য বিষয়কে লেখ্যরূপ দেয়া) দুই ব্যাচকে দিয়ে করিয়েছিলেন। আমাদের আগের ব্যাচ অর্ধেক করেছিল। বাকিটা আমরা সম্পন্ন করি। যেহেতু আমরা পরের অংশ করেছিলাম তাই তিনি আমাদের বললেন, আগের বছরের অর্ধেক যেন আমরা দেখে ‌নিই। আমরা তাদের লেখাগুলো পড়ি। আল্লামা তাকি উসমানি জিজ্ঞেস করলেন আমরা বুঝেছি কিনা। আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি তারপরও আমাদের পড়ালেন। আর আমরা তখনই বুঝলাম আসলে আমরা আগে কিছুই বুঝিনি।

ইসলাম টাইমস : শিক্ষক হিসেবে হজরতের যেসব গুণ আপনাকে মুগ্ধ করেছিল…!

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : একজন ভালো শিক্ষকের সবগুণই হজরতের মধ্যে ছিল। যেমন, হুসনে তারতিব বা বিষয়ের চমৎকার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। সহজবোধ্যতা। হজরতের রচিত তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম আরবি ভাষায় লেখা, পড়লে মনে হবে সহজ উর্দু পড়ছি।

কনফারেন্সে মুফতি তাকি উসমানি

ইসলাম টাইমস : হজরত শায়খুল ইসলামের সঙ্গে দরসের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : দরসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। তবে একটি স্মৃতি আমি উল্লেখ করতে পারি। তা হলো, ইফতার বছর আমাকে মাকালা (গবেষণা প্রবন্ধ) হিসেবে ‘আল আশবাহ ওয়ান নাজায়ির’-এর ব্যাখ্যা লিখতে বলা হয়। আমি আরবি ভাষায় আঠারো শো পৃষ্ঠার একটি ব্যাখ্যা লিখি।

লেখার পর খুব ভয়ে ছিলাম, হজরতের কাছে এটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা। আমার কাজ শেষ হওয়ার পর হজরতের কাছে জমা দিলাম। তিনি তখন সফরে যাচ্ছিলেন। মাকালার ৬ খণ্ডের ৩ খণ্ড সাথে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন পর তিনি সফর থেকে ফিরে এলেন।

দারুল উলুমের রীতি হলো, হজরত সফর থেকে ফিরলে মসজিদের বারান্দায় ইফতার ছাত্ররা দেখা করে। আমি ভয়ে ভয়ে পেছনে পেছনে থাকলাম এবং সবার শেষে দেখা করলাম। দেখা হওয়ার পর হজরত আমার পিঠে দুটো চাপড় দিলেন এবং বললেন, তুমি তো আমার হৃদয় ভরে দিয়েছো। পরে দেখা করার নির্দেশ দিয়ে বিদায় দিলেন।

সেদিন রাতেই হজরত আামার প্রথম ৩ খণ্ড সাথে নিয়ে ইফতা বিভাগে এলেন। অনুযোগ করলেন কেন দেখা করলাম না! তিনি আমার ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রসংশা করলেন এবং প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশনাও দিলেন। সেদিন তিনি আমাকে দারুল উলুম করাচিতে থেকে যাওয়ার (শিক্ষকতার জন্য) কথা বললেন।

আমি দেশে আসার পর হজরত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-ও আমাকে করাচি যাওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, পুঁটি মাছের মাথা খাওয়ার চেয়ে কাতল মাছের লেজ খাওয়া ভালো।

ইসলাম টাইমস : ব্যক্তিগত জীবনে আল্লামা তাকি উসমানি সহজ না গম্ভীর?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : তার পারিবারিক জীবনের কথা খুব বেশি বলতে পারবো না। তবে ছাত্রদের সঙ্গে উনার আচরণ দুই রকম। দাওরা বা তাকমিল পর্যন্ত উনি খুব সহজ ও মিশুক। আর ইফতাতে উনি অনেক গম্ভীর।

ইফতা বিভাগের উনার গাম্ভীর্যর কারণে আমাদের দুই সহপাঠী চলেই যান। একবার এক পাঠান ছাত্র হজরতকে চিঠি লিখেন- আপনার গাম্ভীর্য এত বেশি যে আপনার দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। হজরত তার কাছে অপারগতা পেশ করেন, দুঃখ প্রকাশ করেন।

আমি হজরতের সাথে সফরেও গিয়েছি। সফরে তিনি একদম ভাই-বেরাদার ধরনের আচরণ করেন। মাদরাসার ভাব-গাম্ভীর্যর লেশ মাত্র তখন থাকে না।

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন

 ইসলাম টাইমস : ইফতা বিভাগে এসে তিনি গম্ভীর হয়ে যান। এর কোনো ব্যাখ্যা শায়খুল ইসলাম কখনও দিয়েছেন?

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আমার মনে হয়, বিষয়টি ঐচ্ছিক কিছু নয়। তবে এর দুটি কারণ হতে পারে। এক. সেখানে ইফতা বিভাগে ছাত্র ভর্তি করা হয় অনেক যাচাই-বাছাই করে। সুতরাং তাদের সঙ্গে আচরণটাও তেমনই হওয়ার কথা। আমি দারুল উলুমের ইফতা বিভাগের ৪৩তম বছর সেখান ইফতা শেষ করেছি। এত বছরে মাত্র ৬ জন ছাত্র সেখান থেকে ইফতা সনদ লাভ করেছে। আল-হামদুলিল্লাহ এর মধ্যে ৩জনই বাংলাদেশি। আমি, মুফতি কামাল উদ্দীন রাশেদী ও সিলেটের মুফতি আবদুল মালেক। প্রথম দুইজন মুমতাজ এবং শেষের জন জায়্যিদ জিদ্দান।

দুই. একজন মুফতি ব্যক্তিগত জীবনে ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন হবেন। ইফতার ব্যাপারে ভেবে-চিন্তে মত দেবেন। কোনো ধরনের ব্যক্তিত্বহীনতা যেন তার ভেতর না থাকে, হয়তো সেজন্যই শায়খুল ইসলামের এই গাম্ভীর্য।

(আরেক দিন আরেক পর্ব, ইনশাআল্লাহ)

পূর্ববর্তি সংবাদএলাহাবাদের নাম বদলে ফেলা হলো, ইতিহাসও কি মুছে ফেলা যাবে?
পরবর্তি সংবাদপ্রকট হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম