কুরআন হেফজের সঙ্গে সেক্যুলার শিক্ষা! (শেষ পর্ব)

মুহাম্মদ আদম আলী ।।  

কেবল আলোচনার জন্য বলছি, আপনার এফসিপিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকা আর আল্লাহ আপনাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন—স্বামীকে শান্তিতে রাখা—কখনো চিন্তা করেছেন, আপনি এ দায়িত্ব পালনে কতটুকু সমর্থ হচ্ছেন? আপনারা যারা ডাক্তারীর বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছেন, একটু চিন্তা করেন তো, ঢাকা শহরে যত বড় বড় হাসাপাতাল আছে যেখানে রোগী দেখা হয়, তাদের মধ্যে কতজন হবেন মহিলা? কত পার্সেন্ট হবে? বলেন, আপনি আমার মেয়ের মতো। (তখন ভদ্রলোকের স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে বললেন, খুব বেশি না। তবে গাইনোকোলজিস্টের সংখ্যা অনেক আছে।)

আলহামদুলিল্লাহ। এখন সেখানে শরিয়তের হুকুমের কোনো পরোয়া করা হয়? নামাজের কোনো পাবন্দি করা হয়? নামাজের ইহতিমাম করা হচ্ছে সর্বনিম্ন। আপনি ইচ্ছা করেছেন, আপনার ছেলেমেয়েদের হাফেজ বানাবেন। কিন্তু আপনি এর সঙ্গে ভেজাল দিচ্ছেন। ইংরেজি-বাংলা-অংক এগুলো শিখতে হবে।

আমি বলি, এগুলোর সঙ্গে কুরআন মাজিদের ব্যবহার সতীনের মতো। কুরআন মাজিদ একদিকে, অন্যদিকে হলো ইংরেজি শিক্ষা। কুরআন মাজিদ যেন বলে, তুমি তোমার সিনার মধ্যে আমার সতীনকে রেখেছ (দুনিয়ার ডিগ্রি, পদমর্যাদা ইত্যাদি)—আমি তোমার সিনায় যাব না। কেন বলে?

আমি আমার মতো করে বলছি। আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন? কুরআন মাজীদ যেন বলে, তোমার সিনায় তুমি ইংরেজি-বাংলা সব সমান সমান পৌঁছাতে চাও, আমি আল্লাহর কালাম, আল্লাহ আসমান-জমিন বানিয়েছেন, তাকে তুমি এত সাধারণ মনে করলে? এখানেই রোগের মূল (Root of the disease)।

আল্লাহ বলেন,(আল্লাহ তাআলা অনেক আক্ষেপের সঙ্গে বলেন,) (অর্থ) ‘না না না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখেরাত অনেক ভালো, চিরস্থায়ী।’

হায় তুমি তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিলে। অথচ আখেরাত—লক্ষ লক্ষ বছর না, কোটি কোটি বছর না—আরও দীর্ঘ। আল্লাহ তোমাকে বানিয়েছেন আখেরাতের জন্য। তুমি আমার কুরআনের সঙ্গে দুনিয়ার ডিগ্রি, দুনিয়ার পদমর্যাদা রাখতে চাচ্ছ?

দুনিয়া আমাদের ধোঁকায় ফেলছে। আপনার মানিকদের আপনি হাফেজ বানাতে চান, এজন্য কয়েকটা কথা বললাম। এখন দেরি হয়ে গেছে। তারপরেও আমি দু-জন ছাত্রকে দেখিয়েছি।  তাহমিদের আব্বু (ভদ্রলোকের বড় ছেলের নাম তাহমিদ) ওই দুই ভাইকে দেখেছেন। তারা ভালো স্কুলে ভালো রেজাল্ট করছিল। কিন্তু তারা অতি অল্প সময়ে হাফেজ হয়ে গেছে। কুরআন ত্যাগ চায় (Quran demands sacrifice)। তুমি দুনিয়ার শিক্ষায় ঢুকালে আমি তোমার সিনায় যাব না।

আগের পর্ব : কুরআন হেফজের সঙ্গে সেক্যুলার শিক্ষা!

এখানে আমি ভিন্ন একটি বিষয় বলছি। আপনার সামনে আমার স্ত্রী বসে আছেন। তিনি মাস্টার্স পাশ করেছেন ১৯৭০ সালে। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বড় ভাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে রিটায়ার করেছেন। তার পরের ভাই ডাক্তার, কানাডায় থাকেন, পিএইচডি করেছেন। তার পরের ভাইও ডাক্তার। তার পরের ভাই বিমানে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তার পরের ভাই একটি ওয়েল কোম্পানীর উচ্চ পদে আছেন। তার কোনো বোনই তার মতো মাস্টার্স পাশ করতে পারেননি। এই নয় ভাইবোন সব একদিকে। এখনো একদিকে। এখনো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৌভাগ্য দেন।

আল্লাহ আপনাকে তৈরি করেছেন। মায়ের পেটে তৈরি করেছেন। কুরআন এটির স্বীকৃতি দেয়। মায়েদের সম্পর্কে কুরআন বলে,His mother carried him with difficulties (তার মা তাকে বড় কষ্টে পেটে বহন করেছে)। বড় কষ্টে প্রসব করেছে।

কত কষ্টে তার মা তাকে বহন করেছে। কেয়ামতের ময়দানে দেখা যাবে, কোনটা ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, কোনটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তখন আর ফিরে আসার উপায় নাই। একান্তই আমাদের অতি স্নেহভাজন ও তার স্ত্রীর জন্য একটু স্যাম্পল কথা বললাম।

সারা দুনিয়ার মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের, কুরআন মাজিদের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম বলেন দেখি? কুরআন পড়লে যেহেতু পয়সা পাওয়া যায় না, ডিগ্রি পাওয়া যায় না, সম্মান পাওয়া যায় না, এজন্য এটিকে চরম অবহেলা করা হয়। কুরআন মাজিদে এ বিষয়টি বার বার আলোচনা করা হয়েছে। সুরা ওয়াকিয়ার আয়াত,(অর্থ) ‘তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করবে?’

এই কুরআনের সঙ্গে এত অবহেলা করছ? এটিকে খুব সাধারণ মনে করছ? কুরআন মাজিদের ১১৪টি সুরার মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ সুরাতেই কুরআন মাজিদ নিজেই তার কথা আগে বলেছে।

রাব্বুল আলামিনের নিকট থেকে এসেছে এই কুরআন। সেই মেসেজের দিকে তোমরা এত অবহেলা করছ? চিন্তা করে দেখেন। আপনি গাইনোকোলজিস্ট এক্সপার্ট হন, আল্লাহ কবুল করুন। কিন্তু ক’জন ডাক্তার সুরা ফাতিহা ঠিক করে পড়তে পারবে? আমপারা থেকে একটি সুরা শোনাতে পারবে? আপনার সঙ্গে যারা এফসিপিএস করছেন, তাদের কয়জন কুরআন মাজিদের একটি পৃষ্ঠা পড়তে পারবে?

আমিও এমনই ছিলাম। আমাকে একজন আল্লাহর ওলির সংস্পর্শ এ পথে নিয়ে এসেছে। তার নাম মাওলানা আব্দুল্লাহ রহ.। আজিমপুর কবরস্থান মসজিদের ইমাম ও খতিব। তিনি আমাকে বললেন, হামীদুর রহমান ভাই, একজন হাফেজের সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে রেখে দেন। খেলতে খেলতে হাফেজ হয়ে যাবে। ইংরেজি-বাংলা—সে তো আকাশে-বাতাসে আছে।

এখন তাহমিদের বাবা আমার বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখুক। তারা তো ফরমালি বাংলা-ইংরেজি পড়েনি। কুরআন দাবি করে, তুমি কেবল আমার জন্য হয়ে যাও; আর নইলে তোমার সিনায় যাব না। তোমার কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশি?

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আদম আলীর সঙ্গে আমেরিকা যাওয়ার। ২০১২ সালে। আমি তখন জর্জিয়া স্টেটে আটলান্টার একটি বুকস্টোর থেকে একটি বই কিনলাম। বইটির নাম আই লাভ মাই মম (I love My Mom)। পুরো বইটির মধ্যে প্রতি পৃষ্ঠায় ছবি। আর লেখা : আমার মা আমার জন্য এই এই করে, এজন্য আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু মাকে কে তৈরি করেছে, তার সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। চিন্তা করেন তো!

আল্লাহ আমাদের মায়েদের পেটে কি এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন। কিন্তু যিনি তৈরি করলেন, তার নামও নেওয়া হয় না। আল্লাহ না-ই বলল, গড (God) না-ই বলল, ক্রিয়েটর (Creator) তো বলতে পারে? তিনি সূর্য তৈরি করেছেন। সারা পৃথিবীজুড়ে অক্সিজেন বেষ্টন করে আছে। তার পার্সেন্টেজ সব জায়গায় একই রকম। অক্সিজেন কে বানিয়েছেন? তার কি একটা থ্যাংক ইউ পাওয়ার অধিকার নেই? আপনারা ভালো করেই জানেন, আমরা কিসের মধ্যে ডুবে আছি এখন? অক্সিজেন। আপনাকে কে বানিয়েছে? তাকে কোনো থ্যাংক ইউ দেওয়া হয়?

পানি—এখন তো কিছু পানির জন্য পয়সা দিতে হয়—কত গ্যালন পানি বৃষ্টি থেকে পড়ে? কত টন টন পানি পড়ে? কে বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন এটি? তাকে খুশি করার চেষ্টা কোথায়? একটুখানি সমালোচনা হলে ভয় পেয়ে যাই। কবরে আমাকে একাই যেতে হবে। যাদের আমরা ভয় করছি, কেবলই সমালোচনা কেবলই কিছু কথা—এরকম ভয় সাহাবায়ে কেরাম করেননি। এ যামানায় হাফেজ হওয়া সাহাবিদের মতো হওয়ার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক আমল-আখলাক।আল্লাহ তা‘আলা উপকার দেওয়ার মালিক।

আমি কেবলই আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। কোথায় ছিলেন আপনি, কোথায় ছিলাম আমরা? কোথায় তিনি আমাদের তৈরি করেছেন, আর কোথায় আমাদের ফিরে যেতে হবে? কি অদ্ভুত কাণ্ড। আবার আমাদের জন্মের আগেই সবকিছু তৈরি করে রেখেছেন। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে আমরা বাঁচি। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। বাতাস লাগে। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।

আমি ওই আমেরিকার সফরে ডালাসে এক বাড়িতে ছিলাম। সেখানে বাড়ির সামনে খালি জায়গায় ঘাসগুলো শুকিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাস, ‘ঘাসগুলো এত শুকনো কেন?’ আমাদের মেজবান বলল, ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। ডালাস অথরিটি আমাদের বলেছে, পানি সাশ্রয় করতে।’ আধুনিক পৃথিবীর অনেক আবিষ্কারের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাতের কোনো কিছু এখনো আবিষ্কার হয়নি। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,(অর্থ) ‘তুমি যে পানি পান কর তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, তুমি এ পানিকে মেঘ থেকে নামাও, না আমি নামাই?’

আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্যবতী করুক। একটি দুআ আছে,

اَسْعَدَكَ اللّٰهُ تَعَالٰى فِيْ الدَّارَيْنِ

‘আল্লাহ তোমাকে উভয় জাহানে সৌভাগ্য নসিব করুন।’

আল্লাহ আপনাকে উভয় জাহানে সৌভাগ্যবতী করুন। আমীন।’

বয়ান শেষ হলো। হজরত প্রায় বিশ মিনিট কথা বললেন। তারপর তাদের বিদায় জানালেন। হজরতের এ আলোচনা তাদের উপর কী প্রভাব ফেলল, তা হয়তো শিগগির জানা যাবে। জানা না গেলেও ক্ষতি নেই। আমি সম্ভবত আমার জীবনে হজরতের শ্রেষ্ঠ বয়ান পেয়ে গেলাম। কুরআন হেফজের ব্যাপারে এরকম স্পষ্ট কথা আগে শোনা যায়নি। আল্লাহ হজরতের হায়াত আরও বাড়িয়ে দেন। ইসলামের প্রতি তার অন্তরে আল্লাহ যে দরদ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, আমাদেরও তা দান করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা কেবলই বাড়ছে
পরবর্তি সংবাদঅমৃতসরে আহতদের পাশে দাঁড়াবে জমিয়ত : মাওলানা মাহমুদ মাদানী