নবী জীবনের গল্প : বিনিময়ে তাকে এবং আপনাকে

যিয়াদ বিন সাঈদ ।।

প্রিয়তম নগরী ‘মক্কা’র প্রেমকে মিশিয়ে দিয়ে মাটির সাথে, তিনি চলেছেন মদীনার পথে। এর আগে পরিবার-পরিজন, তারাও তো চলে গেছেন। দিন-দুপুরে কিংবা রাতের গভীরে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কিংবা সকলের অগোচরে, দলে দলে কিংবা ‌একাকী, পায়ে হেঁটে কিংবা সওয়ারীর পিঠে চড়ে। সকলই চলেছেন হিজরতের মহান লক্ষ্যে।
কিন্তু আদরের কন্যা যয়নব? তার কী হবে? এ মুহূর্তে তাকে সাথে নেয়াও যাচ্ছেনা আবার পৌত্তলিক স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদও করানো যাচ্ছেনা। অন্যান্য অমুসলিম আত্মীয়দের সঙ্গে সেও যে রয়ে গেছে মক্কায়। এভাবে কন্যাকে রেখে চলে যাওয়া যায়?
কিন্তু জামাতা ‘আবুল আস’ নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা না করলেও সে খুব ভদ্র। তাঁর আচরণ খুব সুন্দর ও রহস্যজনক। তার ভেতরে কারো সঙ্গে শত্রুতার জের নেই। আবু লাহাব, আবু জাহেলরা তার প্রতি রুষ্টও নয়। নবী মুহাম্মদের জামাতা হয়েই বা কী হবে! সে তো কোরেশদের বিরুদ্ধতা করবার মতো কোনো ‘আবুল আস’ও নয়। মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ধর্ম সে এখনও মেনে নেয়নি। নিলেও বা মনে মনে। অপ্রকাশিত কোনো সংবাদের ওপর ভর করে। কিন্তু যয়নব মুসলমান হলে কী হবে! সে তো তার স্ত্রী। যার আঁজলায় তুলে শরাব, রোজ পান করে সে অনাগত কোনো মহাসংবাদের প্রতীক্ষায়।

আবুল আস চায় মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যাবে। এই এক্ষুণি, সে চিৎকার করে বলবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। কিন্তু তার মন বলে কৌশলী হ’তে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর নিজেকে বিলীন করবার কথাও বলে। সে অনুভব করে অন্যরকম ভালবাসা। পবিত্রতম প্রেম। তার ধারণা বদ্ধমূল হয়, প্রকাশ্যে মুসলিম হলে তার কাছে লুকিয়ে থাকা আমানতের বড় খেয়ানত হবে। মক্কার মুশরিকেরা তার সহায় সম্পদের ওপর চোখ তুলে তাকাবে। মদীনায় চলে যাওয়া মুসলিমদের যে গচ্ছিত আমানত তার বাকশে৷ তা লুটেপুটে খাবে সে পিশাচসুলভ মানুষগুলো। তাকেও বিতাড়িত হ’তে হবে এই মক্কা থেকে। সে চুপ রয়। নীরবে হয়তো বলেও নেয় যখন চোখাচোখি হয় স্ত্রীর সাথে, ‘আমি তোমাদেরই কেউ হে যয়নব’।

দুই.
মক্কার চারোদিকে রটিয়ে দেয়া হয়েছে এক সংবাদ। মুসলিম গুপ্তচরেরা মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলা আক্রমণ করে সব সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। মুশরিকদের মনে প্রতিশোধ আর যুদ্ধের দাবানল জ্বলজ্বল করে উঠছে ক্রমশ। ঘরে ঘরে যুদ্ধের সাজসাজ রব। কোরেশদের প্রধান প্রধান নেতারা মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কাফেলা প্রস্তুত। রণডঙ্কা বেজে উঠলে পথচলা শুরু হবে। এ কাফেলায় সবাই আছে। কুরাইশ নেতা আবু জাহেল, ওতবা শায়বা সবাই আছে। মক্কার সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে এ যুদ্ধে। কোনো অজুহাত চলবেনা। যেতে হবে যুদ্ধে। কিন্তু আবুল আস? সে কি এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারবে? পরিত্রাণ পাবে কোনোভাবে? তাকেও কি ‘অমুসলিম’ পরিচয়ে তলোয়ার উঁচু করতে হবে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে? কী বড় নিঠুর চিত্র। আবুল আস মেনে নিতে চায়না। সে পারেনা। হয়তো এখানেও সে কৌশল অবলম্বন করবে। যুদ্ধেও যাবে। রক্ষা করবে আমানতও।

বদর প্রান্তর। চারোদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ আমেজ। একদিকে শোনা যায় ‘ইল্লাল্লাহর’ ধ্বনি অন্যদিকে হিংসায় ভরা চোখে কলরুদ্ধ চাহনি। এক পক্ষের সেনাপতি স্বয়ং রাসুলে আকবার নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অন্য পক্ষে আবু জাহেল, ওতবা শায়েবারা। আবুল আস আকাশের দিকে তাকায়। ছিন্নভিন্ন এ অন্তরে সে অনুভব করে এক মহাপরীক্ষার। তার তো কোনো উপায় এখন আর নেই নিশ্চিত। পরম শ্রদ্ধেয়, পরম পবিত্রতম মানুষটির বিরুদ্ধে তাকে উঁচা করতে হবে তলোয়ার। কীভাবে এমনটা করবে আবুল আস? সে ভেবে পায়না। সে তো জানে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব। মহামানব। বিস্ময়কর সত্য, অবাক বিস্ময়ের স্থপতি। সে জানে তিনিই হবেন আজকের বিজয়ী। কেননা তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সুন্দরের এই আলোকরশ্মি কখনও নির্বাপিত হবেনা।

শ্বশুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিলেই বা কি! অন্তর্যামী জানেন তার মনের অবস্থা। আবুল আস ভয় পায়না। হিংস্র কুরাইশরা যুদ্ধ করে সব ছিঁড়ে ফেললেও আজকে তাদের পরাজয়ই অবশ্যম্ভাবী। কোনোরকম যুদ্ধের ময়দানে থাকলেই হলো। মুসলিমদের কাছে বন্দী হলেও তারা তার কোনো ক্ষতি করবেনা, এ বিশ্বাস আবুল আসের আছে। তাছাড়া সে তো মুসলিমদের কোনো ক্ষতি করেনি। আবু জাহেলদের মতো কোনো অন্যায়ও করেনি। তাই হয়তো আজকের যাত্রায় সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। পেয়ে যাবে নিশ্চিত।
তাই সে এসেছে। বদর প্রান্তরে কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধে এসেছে। ঐ তো মুসলিম বাহিনী একে একে বিরোধী কুরাইশদের পরাভূত করছে। বাহ্যত দৃষ্টিতে মুখটুকু মলীন হয়ে গেলেও, আবুল আস অনুভব করছেন এক মহাপুলকের মজ্জা। শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহ হত্যা করে ফেলেছেন ওয়ালীদকে৷ বীরকেশরী হযরত হামযা উড়িয়ে দিয়েছে ওতবার গর্দান। আর শায়বাও পরাভূত এদের কাছে। ওদিকে আবু জাহেলের বিরুদ্ধে লড়ছেন কিশোর মুয়ায মুওয়ায়েয। মস্তক ছিন্ন করে ফেলেছেন তরবারীর আক্রোশে আক্রোশে। যে আবু জাহেল মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলো নবী মুহাম্মদের নিশানা। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো আশ্রিত সাহাবীদের মদীনাকে। নেভাতে চেয়েছিলো আল্লাহর নূরের ঔজ্জ্বল্যকে। তাকেই কিনা আজ নিঃশেষ হ’তে হলো এ দুই কিশোরের তরবারি তলে। কী অভূতপূর্ব!

তিন.
রাসুলের জামাতা বন্দী শিবিরে প্রহর গুণছেন। আবুল আসের হৃদয় লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আসে। যদিও তার হৃদয়ের এক কোণে জলছে আনন্দের ফল্গুধারা। মুসলিমেরা সত্যের ধারক হয়ে তুলে ধরতে পেরেছেন হকের পতাকা। বিজয়ী হয়ে সুর তুলতে পেরেছেন মহাসত্যের৷ অন্যদিকে লজ্জা আর বেদনা রাসুলের জামাতা হয়ে এসেছিলো বিপক্ষে লড়তে, এখন বন্দী হয়েছে। সাহাবাদের সম্মুখে রাসুলের মুখটুকু লজ্জায় অবনত হয়ে যাবেনা তো? হায় হায়। কী অন্যায়ই না করেছে আবুল আস। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে তার ওপরে তো আছেন এক অন্তর্যামী। তিনি জানেন সবকিছু। জানেন অন্তরের ভেতরে, অতলে, যা কিছু ঘটছে, তার সবটুকু। আবুল আস এসব ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয়৷ শান্ত করে তোলে।

কিন্তু মক্কায় পড়ে থাকা তার স্ত্রীর কী হবে? কী হবে নবি কন্যা যয়নবের? সে রেহাই পাবে তো ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে ফিরে যাওয়া কুরাইশদের কাছ থেকে? আহা! প্রিয়তমা স্ত্রী কী ভাবছেন তা জানেনা আবুল আস। এমন স্পর্শকাতর মুহূর্তে সে যদি ভাবে, তার স্বামী পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, এখন ক্ষণ গুণছে বন্দীশালায়; যদি সে চলে যায় তাকে ছেড়ে! রাসূলের অস্তিত্বের একটি অংশ যদি ছিঁড়ে খসে যায় তার ভাগ্য থেকে, কী হবে তার! আবুল আস চিন্তিত হয়ে পড়ে আবার। সে আরও ভাবে, যয়নব তো চাইলে পারতো স্বামীকে ছেড়ে পিতার সঙ্গে মদীনায় চলে যেতে। সে তো তা করেনি।
মক্কার কুরাইশরা অর্থের বিনিময়ে একে একে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে আত্মীয়দের, কিন্তু আবুল আস? তার ভাগ্যের আকাশে আজ কি কোনো চাঁদের দেখা মিলবে?
প্রিয়তমা স্ত্রী কি তার জন্যে কিছু করবে? হয়তো। যয়নব তো তার খালাম্মা মা খাদিজারই কন্যা। মা খাদিজা যেমন করে স্বামীর পদতলে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন সম্পদের মহাপ্রাচূর্য, তারই কন্যার কাছে এমনটা আশা করা তো অসম্ভব কিছু নয়।

মক্কার লোকেরা একে এক ফিদয়াহ প্রদান করে মুক্ত করে নিচ্ছে আপনজনদের। যয়নব ভাবছে, কী পাঠাবে ফিদয়া হিসেবে তার স্বামীর জন্যে! কী বিনিময় করবে প্রিয়তম স্বামীর সাথে। আজকের মদীনায় রাষ্ট্রনেতা তো তারই পিতা। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তো চাইলে নিজ কন্যার স্বামী এমনিতেই ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু এমনটা তিনি করবেন কেন? সবাই দিবে মুক্তিপণ আর রাসূলের জামাতা বলে সে এভাবেই মুক্তি পেয়ে যাবে, তা কী করে হয়! তিনি তো দয়ার অর্গল বুকে ধারণ করলেও ন্যায়বিচারের এক অনন্য ধারক। সবার মতোই হবে তার প্রিয়জনদের বিচার।
যয়নব ভাবে সে ফিদয়া দিবে। কিন্তু কী দিবে? কী আছে তার এমন। সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ফিদয়াই তাকে দিতে হবে স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে। কেননা তার স্বামী তো নবী কন্যা যয়নবের স্বামী। যে কন্যার সঙ্গে মিশে আছে রাসূলের অবয়ব। তার জন্যে হতে হবে অবশ্যই সব থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো কিছু। যয়নব ভাবেনা আর। সে স্বামীর মুক্তির জন্যে মদীনায় পাঠিয়ে দেয় শ্রেষ্ঠতম এক মুক্তিপণ।

বন্দী আবুল আসের ফিদয়া হিসেবে যখনি রাসূলের সামনে তুলে ধরা হয় একটি চমৎকার লকলকে হার, নবীজী একটু চমকে উঠেন৷ চোখ দুটো ভিজে যায় নবীজীর। প্রিয়তম স্বামীর জন্যে স্ত্রী তার মায়ের সর্বশেষ স্মৃতিটুকু পাঠিয়ে দিয়েছে। যয়নব, সে তো চেয়েছে পিতার কোনো মানহানী না হোক। লজ্জায় না পড়ুক তার পিতা। নবীজী আবেগের তাড়নায় দুলতে থাকেন। এ হার তো খাদিজার গলায় থাকা এক মূল্যবান হার৷ সহধর্মিণী, প্রথম মুসলিম, প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত হার। পৃথিবীর সব সম্পদ এর কাছে তুচ্ছ। এ তো অমূল্য রতন। কী করে এটি বাইতুল মালের সঙ্গে মিশে যাবে। কেবল যয়নবের গলায়ই এ হার মিশে থাকতে পারে। পৃথিবীর কোনো হাতের স্পর্শ কি এর সঙ্গে যায়!
রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ হার পাঠিয়েছে আমার কন্যা যয়নব। এ হারটি তার মায়ের। ইচ্ছে করলে হারটি তোমরা পাঠিয়ে দিতে পারো। মক্কা গিয়ে আবুল আস যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেবে। এই তার ফিদয়াহ।
কী অতুলনীয় সমাধান। মানুষের বিনিময়ে মানুষের মুক্তি। যয়নব তো মুসলমান। সে কেন অসহনীয় জাতাকলে কষ্ট করতে থাকবে দারুল হরবে। সে ফিরে আসবে শান্তির ময়দান, মদীনার আবাসে। পিতার রাষ্ট্রে। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজার হার গলায় নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে আসবে পিতার আশ্রয়ে৷

মহামূল্যবান এ হারের বিনিময়ে যয়নব ফিরে পেলো স্বামী আর নবীজী পেলেন আদরের কন্যা যয়নবকে।

পূর্ববর্তি সংবাদকথা দিলাম, কুমিল্লার নামেই কুমিল্লা বিভাগ হবে : আইনমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি বড় পরীক্ষা : রাষ্ট্রপতি