গতকাল রাতে মারা গেছেন তরুণ আলেম ও লেখক মাওলানা রাশিদুল হক। লেখালেখির অঙ্গনে বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা তরুণ এ আলেমের স্মৃতিচারণ করেছেন ইসলামি ধারার চার অগ্রজ লেখক। তাদের স্মৃতিতে উঠে এসেছে তার লেখালেখি, জ্ঞানচর্চা ও ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা।
সবকিছুর সাথে বিনয় ছিলো তার বিশাল সৌন্দর্য্য
শরীফ মুহাম্মদ, সম্পাদক, ইসলাম টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম
তরুণ আলেম ও লেখক মাওলানা রাশিদুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় ৬-৭ বছর আগে। তখন বুঝতে পারিনি তিনি একজন লেখক। এরপর বিভিন্ন সময় তার লেখা দেখেছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিভার দীপ্তির সঙ্গে তার বিনয়টা আমার কাছে বিশাল সৌন্দর্য্য মনে হয়েছে। সাক্ষাৎ বা ফোনে যোগাযোগের সময় বিনয়টা প্রকাশ পেতো।
শেষের দিকের একটা ঘটনার সঙ্গে আমার আফসোস জড়িয়ে আছে। সম্ভব দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর তিনি তার শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন। আমি কাছেই কোনো এক মাহফিলে বয়ান করছিলাম। বয়ান শেষে আমার মোবাইলে একটি ম্যাসেজ আসে। সেখানে তিনি আমার বয়ানের ব্যাপারে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। আমি ফোন দেই এবং তাকে দেখতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি।
এরপর কয়েকদিন ফোনও দিয়েছি কিন্তু রিসিভ হয়নি। আমারও চেষ্টা করা হয়নি। আমি মাওলানা সাদ আবদুল্লাহ মামুনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু হয়ে উঠলো না। এই দুই দিন আগেও আমি ভেবেছিলাম তার উপর ইসলাম টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি স্টোরি করবো যে, একজন মেধাবী তরুণ আলেম দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কিভাবে বিছানায় পড়ে আছেন।
গতকাল মধ্যরাতে তার মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারি। দেখে আমার খুব আফসোস হচ্ছে। এতো নম্র, ভদ্র ও মেধাবী একজন তরুণ এভাবে চলে গেলো! আমি আশ্চর্য হয়েছি, এতো অসুস্থতার মধ্যে কখনো নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেননি।
আমি তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। বিশেষত তার পবিবারের জন্য দোয়া চাই। সবাই যেন দোয়া করি এবং খেয়ালও করি।
অল্পদিনেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন
জহির উদ্দিন বাবর, সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
তার সঙ্গে আমার খুব বেশি দিনের পরিচয় নয়। কিন্তু যে কয়দিন দেখা হয়েছে অমায়িক মানুষ বলেই মনে হয়েছে। হাসি-খুশি ও ভদ্র মানুষ বলেই মনে হয়েছে। সব সময় চেহারায় হাসি লেগে থাকতো। খুব নম্র স্বভাবের লোক ছিলেন।
বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রে ফোনে কথা হতো, ফেসবুকে চ্যাটিং হতো। লেখালেখি খুব বেশিদিন আগে শুরু করেননি। কিন্তু অল্পদিনেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। তার চেষ্টা ও পরিশ্রম ছিলো চোখে পড়ার মতো। প্রচুর লিখতেন। ভালো লিখতেন।
তরুণ মেধাবী এ আলেমকে আল্লাহ যেন ক্ষমা করেন এবং জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন।
তিনি ছিলেন আমাদের নির্বাচিত লেখক
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আযহারী, সত্ত্বাধিকারী, মাকতাবাতুল আযহার
লেখক মাওলানা রাশিদুল হক ছিলেন আমাদের একজন নির্বাচিত লেখক। আমরা আমাদের আল-লু’লুউল মাকনুন নামক সিরাত সিরিজের জন্য সারা দেশ থেকে ১১ জন লেখক নির্বাচন করেছিলাম। তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।
তিনি সিরাত সিরিজে কাজও শুরু করেছিলেন এবং ১২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখেছিলেন। এর মধ্যেই তার এক্সিডেন্ট হয়। যতোটুকু করেছেন সবাই পছন্দ করেছেন। আমাদের ইচ্ছে ছিলো তাকে দিয়ে পুরো এক খণ্ডের কাজ করানো। তার কাজটুকু আমরা যত্নের সঙ্গে রেখে দিয়েছি। বাকিটা অন্য একজন করেছেন।
দুর্ঘটনার পর তিনি একটু সুস্থ হলে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি তখন কাজটা শেষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরাও মেনে নেই। কিন্তু ছয় মাস অপেক্ষা করার পর আমরা আবার যোগাযোগ করলে তিনি কাজটা ছেড়ে দেন। তখন অন্য খণ্ডগুলোর কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে বোঝা যাচ্ছিলো সিরাতের কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত থাকতে খুবই আগ্রহী ছিলেন।
এতো ভদ্র ও শরিফ মানুষ খুব কম দেখেছি। আমরা তার পরকালীন জীবনের কল্যাণ কামনা করছি।
আমি তাকে আখলাকের শায়খ বলতাম
আলী হাসান তৈয়ব, সহ-সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ
আমার দেখা বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণদের একজন ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ রাশিদুল হক। তার লেখালেখি খুব বেশি দিনের নয়। চার বছর আগে তিনি দৈনিকে লেখা শুরু করেন। আলোকিত বাংলাদেশে আমাদের পাতায় প্রথম লেখেন।
একদিন বিকেলে অফিসে এলেন ফোন দিয়ে। সাথে আইসক্রিমের বড় একটি বাটি নিয়ে আসলেন। তিনি সেদিন আমার প্রতি যে বিনয় ও মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন। আমি তাতে আড়ষ্ট কুণ্ঠিত হলাম। কিন্তু দীর্ঘ আলাপে আর আচরণে মুগ্ধ হলাম আমিও।
এরপর বহুবার দেখা ও কথা হয়েছে। আমার অফিস বা বাসার এলাকায় আসলে তিনি ফোন দিতেন, দেখা হতো দুইজনের। তার কথায় প্রায় উম্মাহ, আলেম উলামা ও দেশ নিয়ে উগ্বেগ প্রকাশ পেতো। তিনি চাইতেন ইলম ও আমলে ভালো এমন মানুষ লেখালেখিতে আরও বেশি আসুক। এ প্রত্যাশা আমারও।
আলোকিত বাংলাদেশের ‘নবীজীবন’ পাতায় নিয়মিত লিখতেন। আমি তাকে বন্ধু মনে করতাম। কিন্তু তিনি বিনয় প্রকাশ করে আমাকে ‘লেখার শায়খ’ বলতেন। লেখকদের মধ্যে এমন আখলাকি মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না। আমি বলতাম আপনি আমার ‘আখলাকের শায়খ’।
লেখক হিসেবে তার একটা গুণ আমাকে মুগ্ধ করতো তাহলো কখনও কোনো লেখা দেয়ার কথা দিলে দ্বিতীয়বার ফোন দেয়া লাগতো না। নিজেই পাঠিয়ে দিতেন।
রাশিদ ভাইয়ের অসুস্থতার কথা আগেই জেনেছিলাম। কিন্তু এবার হজ্জের সফরে দারুর রাশাদ মাদরাসার শায়খুল হাদিস হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে তার অবস্থা জেনে আঁতকে উঠেছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, দেখতে যাবো কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। যা আমার সারা জীবনের জন্য দুঃখ হয়ে থাকবে।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী শুক্রবার মারা যাওয়ার ফজিলত আছে। তিনি শুক্রবার চলে গেলেন। আল্লাহর দরবারে তার জন্য মাগফিরাত ও উত্তম আচরণ কামনা করছি।
