ইসলাম টাইমস ডেস্ক ।। ‘বাংলাদেশের মাদরাসাশিক্ষিতদের ৭৫ শতাংশ বেকার’-এমনই দাবি করা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাগ্রন্থে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামের ওই গবেষণাগ্রন্থে এমন দাবি করা হয়।
এ বছর জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বনাম শিক্ষা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ শীর্ষক আলোচনাসভার মাধ্যমে মোড়ক উন্মোচন করা হয় ওই গবেষণাগ্রন্থের।
ওই গবেষণাগ্রন্থে দাবি করা হয়, দেশের শিক্ষার্থীদের প্রতি তিনজনের একজন মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। অর্থাৎ দেশের ৩৩% শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন কওমি অথবা আলিয়া ধারার মাদরাসায়।
গবেষণাগ্রন্থে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালে সারা দেশে মাদরাসার শিক্ষার্থী ছিল ১ কোটি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫২ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেন।
১০ বছরে এই সংখ্যা আরও বহুগুণ বেড়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই আলোচনাসভার বক্তারা।
মূল বইটি ২০১১ সালে ইংরেজিতে প্রকাশ হয় Political Economy of Madrasa Education in Bangladesh নামে। বইটি লিখেন অধ্যাপক আবুল বারকাত, রওশন আরা, তাহের উদ্দিন, ফরিদ এম জাহিদ ও মোহাম্মদ বদিউজ্জামান। ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামে যেটির ভাষান্তর প্রকাশ করা হয় এ বছর জানুয়ারি মাসে। ভাষান্তর করেছেন সেলিম রেজা ও সাজেদা রেহানা। বইটির প্রকাশক বাংলাদেশের র্যামন পাবলিশার্স।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির নির্ধারিত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, ‘গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৯২ ভাগ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাদরাসায় পড়েন। কিছু নিম্ন-মধ্যবিত্ত আছেন যারা তাদের সবচেয়ে কম মেধাবী সন্তানকে মাদরাসায় পড়ান। মাদরাসায় শিক্ষিতদের ৭৫ শতাংশ বেকার।’
আবুল বারকাত তার প্রতিবেদনে আরও বলেন, এই বেকারদের হাতে যদি কোনো কিছু তুলে দিয়ে বলা হয়- ইসলামী রাজ কায়েমের লক্ষ্যে নেমে পড়ো, তাহলে তাদের নামানো সহজ। মাদরাসা শিক্ষা পশ্চাৎপদ, এতে কোনো সংশয় ও দ্বিধার কারণ নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক মানসকাঠামো বিনির্মাণে এই শিক্ষা ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, জঙ্গি উৎপাদন এবং পুনঃউৎপাদকের ক্ষেত্রে এই শিক্ষার বেশ উর্বর ভূমিকা।
গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি দাবি করেন, ১৯৭০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে। বছরে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ। আর মাদরাসা বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মাদরাসার মধ্যে আলিয়ার চেয়ে কওমির বৃদ্ধির হার বেশি। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, আর মাদরাসায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
মাদরাশিক্ষা বিষয়ে এমন অভিযোগের ব্যাপারে এই প্রতিবেদক কথা বলেন বিশিষ্ট মিডিয়াব্যক্তিত্ব শরীফ মুহাম্মদের সঙ্গে। তিনি অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণাগ্রন্থ ও প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেন, ‘অধ্যাপক আবুল বারাকাতের মাদারাসাবিষয়ক এবং জঙ্গিবিষয়ক বিভিন্নি আলোচনা এর আগেও মিডিয়ায় এসেছে। তার এসব বক্তব্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও হয়েছে। এ গবেষণাগ্রন্থে এমন অনেক তথ্য পেশ করার চেষ্টা হয়েছে যেগুলো শুনতে চটকদার কিন্তু পুরোপুরি অবাস্তব। এগুলো গাঁজাখুরী তথ্য বললেও ভুল হবে না।’
‘৭৫ শতাংশ মাদরাসাশিক্ষিত বেকার’-এর বাস্তবতা আসলে কতটুকু? এমন প্রশ্নের জবাবে শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘আমি জানি না তার দৃষ্টিতে বেকারত্বের মানদণ্ড কী; কিংবা তার গবেষণাগ্রন্থে তিনি কোন পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদরাসাশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার নির্ণয় করলেন। বড় ব্যবসায়ী হওয়া, ডাক্তার হওয়া, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর হওয়ার মানদণ্ড দিয়ে কি তিনি বেকারত্বের মানদণ্ড ঠিক করেছেন? যে ডাক্তার নয় সে বেকার? যে পাঁচ লাখ টাকা আয় করে না সে বেকার?
‘মাদরাসা থেকে পাশ করে যারা মাদরাসা বা মসজিদে চাকরি করছেন, তিনি এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বেকার বলে অভিহিত করেছেন। কেন? এগুলো কি সম্মানজনক এবং আয়বহুল পেশা নয়? যারা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তাদের পরিবার কি স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছে না? খোঁজ নিলে দেখা যাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর প্রফেসরদের চেয়ে একজন মসজিদের ইমাম বা একজন মাদরাসাশিক্ষক অনেক সুখী জীবনযাপন করেন। কেবল অর্থনীতির সূত্র দিয়ে সুখী জীবনযাপন বা বেকারত্বের অনুপাত নির্ণয় করা যায় না।

‘এগুলো বলা হচ্ছে মাদরাসশিক্ষাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। বাংলাদেশে ১ পার্সেন্ট মাদরাসা শিক্ষিতও বেকার নয়। তাছাড়া মাদরাসাশিক্ষিতদের সবচে বড় গুণ হলো তাদের নৈতিকতা। সমাজের নৈতিকতা উন্নয়নে মাদারাসাশিক্ষিতদের প্রশংসা সর্বমহলে স্বীকৃত।’
মাদরাসার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। জঙ্গিবাদের সঙ্গে মাদরাসাশিক্ষিতদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিগত দুই-তিন বছর ধরে বলে আসছেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে কওমি মাদরাসার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। সেখানে নতুন করে এ ধরনের দাবি উত্থাপন করা নিতান্ত হাস্যকর।’
অধ্যাপক আবুল বারাকাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আবুল বারাকাত কতটা অর্থনীতিবিদ সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান থাকাকালে কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এমন অভিযুক্ত লোক বাংলাদেশের মাদরাসাশিক্ষা বিষয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার রাখেন কি-না, সেটাও ভাববার বিষয়। তিনি তাঁর দুর্নীতির অভিযোগকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য মাদরাসাশিক্ষা বিষয়ে এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রচার করছেন বলেই আমার মনে হয়।’
উল্লিখিত গবেষণাগ্রন্থ ও গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে ইসলাম টাইমস থেকে অধ্যাপক আবুল বারাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
