বসনিয়া গণহত্যার ভয়াবহ স্মৃতিচারণ

আবরার আবদুল্লাহ ।। 

১৯৯২ সালের মে ও আগস্টের মাঝে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বসনিয়ান মুসলিমকে হত্যা করা হয়। যারা ছিলো বসনিক ও ক্রোট বংশোদ্ভূত। তাদের হত্যা করা হয় প্রিজেডর শহরের আশেপাশে এবং ওমরস্কা বন্দী শিবিরে।

‘প্রিজেডর ছিলো একটি প্রাণবন্ত শহর। এ শহরের মানুষরা মিলেমিশে বাস করতো। তারা ছিলো পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল। এখানের মসজিদ ও গির্জাগুলো ছিলো মুখোমুখি। শহরের বাসিন্দারা ধর্মের বিচার না করে পরস্পরের বিয়ে ও শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করতো। ধর্ম তাদের সামাজিক বন্ধনে বাধা ছিলো না। তখন এটা ছিলো যুগোস্লাভিয়ার অংশ।’ কথাগুলো বলেন বসনিয়ার একজন প্রকাশক ও সাংবাদিক রেজাক হুকানভিক। যিনি ওমরস্কা বন্দী শিবির থেকে জীবিত ফিরেছিলেন।

১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। স্লোভানিয়া ও ক্রোয়েশিয়া পৃথক হয়ে যায়। সার্বিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ছিলো ফেডারেশনের অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের। ভয় ছিলো – সংঘাতের কারণে বসনিয়া-হার্জগোভেনিয়াও পৃথক হয়ে যাবে। তারা অবশ্য ততোদিনে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলো।

সার্বরা চাচ্ছিলো যুগোস্লাভিয়ার সাথে থেকে যেতে এবং গ্রেটার সার্বিয়া গড়ে তুলতে। এর পেছনে তারা চরমপন্থী বেলগ্রেডের সমর্থন পেয়েছিলো। ফলে বসনিয়ানদেরকে নিজ আবাস থেকে উচ্ছেদ করা হয় জাতিগত নির্মূলের মাধ্যমে।

মুসলিমদের লাশের উপর পা রেখে উদ্ধত সার্ব সেনারা

সংঘাত শুরু হয় উত্তর বসনিয়া-হার্জগোভেনিয়ার প্রিজেডর শহর থেকে। সার্বিয়ান সেনাবাহিনী ও পুলিশ কয়েক হাজার বসনিক ও বসনিয়ান ক্রোটকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ ও গ্রেফতার শুরু করে। সঙ্গত কারণেই তাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বসনিয়ানরা।

৩০ এপ্রিল ১৯৯২ তারিখে সার্ব সেনাবাহিনী ও ডেমোক্রেটিক পার্টি যৌথ অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা জোরপূর্বক নির্বাচিত সকল বসনিক ও ক্রোট প্রতিনিধিদের ক্ষমতাচ্যুত করে। তাদের প্রশাসন থেকে সরিয়ে দেয় এবং সর্বময় ক্ষমতা দখল করে।

শহর, শহরের পুলিশ স্টেশন, আদালত, ব্যাংক, নগরভবন, রেডিও স্টেশন ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম সবকিছু তাদের দখলে চলে যায়।

৩১ মে ১৯৯২ তারিখে সার্বিয়ান দখলদার বাহিনী প্রিজেডর শহরের সার্ব নয় এমন অধিবাসীদের বাড়িতে সাদা পতাকা উত্তোলন করতে এবং হাতে সাদা বাহুবন্ধনী বাঁধার নির্দেশ জারি করে। এভাবে মুসলিমদের চিহ্নিত করে কয়েক হাজার বসনিক ও ক্রোটকে আটক করে ওমরাস্কা ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

সার্বিয়ান বাহিনী বসনিয়া-হার্জগোভেনিয়ায় কয়েকশো বন্দী শিবির স্থাপন করে। ওমরাস্কা ছিলো সবচেয় কুখ্যাত বন্দী শিবির যেখান থেকে খুব কম লোকই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে।

রেজাক হুকানভিকের মতো প্রাণে বেঁচে যাওয়া বন্দীরা এই ক্যাম্পে পিতা-পুত্রকে পরস্পরের সামনে খুন হতে দেখেছে। তাদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করতো বন্দী শিবিরের সৈনিকরা।

সিভাক নামের আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা করছিলো নারী ও কিশোরীদের কিভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিলো সেখানে। ‘এমন দৃশ্য দেখে একজন সশস্ত্র মানুষের বিপক্ষেও নিজেকে সংযত রাখতে পারবেন না। একজন নারী যখন ধর্ষকের ঘর থেকে বের হয়ে আসতো সে দৃশ্য ভাষায় বর্ণনার যোগ্য না। আবেগ ধরে রাখার মতো নয়। এ দৃশ্য দেখার পর আপনি নিজেও নিজেকে ভয় করবেন। আপনি দ্বিতীয়বার তাকে প্রশ্ন করার সাহস পাবেন না কে তোমার এই দশা করেছে, কোথায় কিভাবে তা হয়েছে।’

বসনিয়ার বন্দী শিবিরে মুসলিম

ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের সাবেক সংবাদকর্মী ইডি ভুলিয়ামি এই দৃশ্য দেখতে পান যখন তিনি বন্দী শিবির পরিদর্শনে যান। বন্দীদের শারীরিক অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। তাদের মাথা মুণ্ডানো, ভগ্ন চোয়াল, শীর্ণ শরীর, ফোলা ফোলা চোখ, শক্তিহীন ও কংকালসার শরীরের মানুষগুলো দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান।

তিনি এবং আইটিএন-এর রিপোর্টার পেনি মার্শাল তাদের একটি পাত্রে স্যুপ ও কিছু রুটি খেতে দেন। তিনি দেখলেন যে তারা খুব বেশি খেতে পারলো না। ‘আমরা তাদেরই সবচেয়ে ভালো অবস্থায় দেখেছিলাম। কিন্তু ওমরাস্কার ভালো ছিলো ভয়ঙ্কর।’ বলছিলেন ইডি ভুলিয়ামি।

পেনি মার্শাল ওমরাস্কা বন্দী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে যা দেখেছিলেন তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছিলেন, ‘বন্দীদের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। আমি জীবনে একবারই এ দৃশ্য দেখেছি। আমি প্রার্থনা করি, আর কোনোদিন যেন তা দেখতে না হয়। মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষের চেহারা কল্পনা করা যায় না।’

গণহত্যার সমাধিক্ষেত্রে কান্নারত পিতা-পুত্র

ওমরাস্কা বন্দী শিবিরটি কয়েক মাস চালু ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য এখানেই দেখা দিয়েছিলো। অবশ্য ক্যাম্পটি বন্ধের বার্ষিকীতে (৬ আগস্ট ১৯৯২) তাকে জনগণের জন্য স্থায়ীভাবে খুলে দেয়া হয়েছে। এখানে প্রিজেডরে নিহতদের স্মরণে সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।

২০০০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রিজেডর ও ওমরাস্কার নির্যাতনের বিচার শুরু হয়। তবে তখনকার বহু অপরাধী আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তারা এখনও প্রিজেডরে বাস করে। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, বন্দী শিবির থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকেই তাদের নিপীড়কদের মুখোমুখি হয়, যারা তাদের ধর্ষণ করেছিলো।

সিভাক ও হুকানভিক তাদের উপর অত্যাচারীদের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের ভাষায়- ‘আমি ক্যাম্প রক্ষীদের সাথে দেখা করেছি। তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। কিন্তু আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি এবং তাদের চোখের দিকে তাকিয়েছি।’

আলজাজিরা অবলম্বনে

পূর্ববর্তি সংবাদআজ বিকালে ঢাকা ছাড়ছেন বার্নিকাট
পরবর্তি সংবাদআরব আমিরাত আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্বোধন