শুকরানা মাহফিল নিয়ে সেকুলার শিবিরে ক্ষোভ-হতাশা

আতাউর রহমান খসরু ।।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে সম্মিলিত কওমি শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া, বাংলাদেশের আয়োজিত শুকরানা মাহফিল নিয়ে আলোচনার রেশ যেন শেষই হচ্ছে না। তা নিয়ে চলছে নানান তর্ক-বিতর্ক। চলছে পরস্পর বিরোধী সমীকরণও। আলোচনায় শুকরানা মাহফিলকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব থেকে শুরু করে আদর্শিক জায়গা থেকে তা কতোটা অর্জন আর ঠিক কতোটা বিসর্জন তা নিয়েও বিস্তর বিশ্লেষণ চলছে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনই এসব সমীকরণের মূল কারণ। জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় শুকরানা মাহফিলের একটি রাজনৈতিক চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন তারা। তাই আদর্শিক জায়গার তুলনায় শুকরানা মাহফিলের রাজনৈতিক মূল্যায়নটাই বেশি হচ্ছে।

তাদের দাবি, শুকরানা মাহফিলের মঞ্চ থেকে একটি বিশেষ দলের পক্ষে বার বার ভোট প্রার্থনা করার পর তার রাজনৈতিক মূল্যায়নকে অমূলক ও ভিত্তিহীন বলার সুযোগ থাকে না।

আদর্শিক জায়গা থেকেও শুকরানা মাহফিলকে গুরুত্ব দিচ্ছে ইসলামপন্থী ও সেকুলার উভয় পক্ষই। আদর্শের দেয়াল টপকে এভাবে একাকার হয়ে যাওয়া পছন্দ করছে না কোনো পক্ষই। এ ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীরা কিছু সহিষ্ণু ও সহনশীল। তাদের ক্ষোভ ও মনোবেদনার প্রকাশ ঘরোয়া পরিবেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেকুলারদের উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। সেকুলার ও বামপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু মুখ ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে তাদের ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়েছেন।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারসহ দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে শুকরানা মাহফিলের উপর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তারা তাদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

তারা তাদের বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম ও হাইআতুল উলয়াকে এক ও অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। উভয় প্রতিষ্ঠানকে একই মার্জিনে রেখে বিচার করেছেন । যদিও হেফাজতে ইসলাম ও হাইআতুল উলয়া উভয়পক্ষই বার বার বলছে তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য অনেক।

সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, শুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ উচিৎ হয়নি। শুকরানা মাহফিলে তার অংশগ্রহণ এক ধরনের ‘অপ্রত্যাশিত আপোষ’। যা তাদের হতাশ করেছে।

এর বিপরীতে একদল তরুণ নাস্তিক্যবাদী ব্লগার মনে করছে শুকরানা মাহফিল আওয়ামী লীগের কাছে হেফাজতের (ইসলামপন্থী অর্থে) আত্মসমর্পণ। দেশের রাজনীতিতে বামধারার নেতৃত্ব দানকারী নেত্রীকে মঞ্চে এনে সম্মানিত করে হেফাজত মূলত সেকুলারদের কাছে আত্মসর্পণই করেছে।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় শুকরানা মাহফিল সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘এটি হচ্ছে এক ধরনের আপোষ। যা অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা এরা যে দাবি করছে, এই দাবি তো বাড়তে থাকবে।’

তিনি হেফাজতকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আখ্যা দেন এবং শুকরানা মাহফিলের কারণে আলেম-উলামার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তার ভাষায় ‘আজকের পর থেকে ওরা যে ক্ষমতা দেখাবে, তাতে ওদের দাবির তালিকা আরও বাড়িয়ে ফেলবে। এরা তো অনেক কিছু চাইবে, শেষে প্রতিক্রিয়া দেখানোও শুরু করবে। কাজেই এটি তো একেবারেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সরকার কীভাবে এদের ছাড় দিচ্ছে, সেটি ভেবে আমরা ভীষণ মর্মাহত।’

একই প্রতিবেদকের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী শুকরানা মাহফিলকে দ্বিপাক্ষিক ধান্দা হিসেবে অবহিত করেন।

তিনি বলেন, ‘এটা তো একটি রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি। যারা আজকের এই সমাবেশ করছেন, এটা তাদেরও স্ট্র্যাটেজি, তারা কিছুটা আদায় করবেন। যারাই এগুলো মেনে নিচ্ছেন … তারা ভাবছেন তারাও এখান থেকে কিছুটা আদায় করে নেবেন। দুই পক্ষই কিছুটা আদায়ের ধান্দায় আছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে আমাদের সংবিধানে যে মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলা আছে, সেগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে।’

কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এটা অস্বীকার করছি না যে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার কোন গুরুত্ব নাই, মূল্য নাই। কিন্তু কোনো কিছু মূল্যায়ন না করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা স্তরকে সাধারণ শিক্ষার সমমানে উন্নীত করা হলো, এটা খুবই দুঃখজনক।’

হেফাজতে ইসলাম, কওমি মাদরাসা ও কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি সবকিছু নিয়েই নিজের প্রচণ্ড ক্ষোভ ঢেলে দেন সেক্যুলার ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সাধারণ শিক্ষার ডিগ্রির সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো, সেটিকে আমি বর্জন করি। এখানে যা করা উচিত ছিল, কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম সাধারণ শিক্ষার সমমানের কি না, তা যাচাই করা। বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার পরেই এ ধরনের সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। গোটা ব্যাপারটিই আমার কাছে মনে হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। হেফাজতে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী সংগঠন। তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কৌশলগত হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বলছে যে, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনোদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না।’

একইভাবে বিবিসি বাংলাকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে ব্লগার আইরিন সুলতানা হেফাজতে ইসলামের অনুষ্ঠানে কওমি প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে এটা হয়তো একটা কৌশল হতে পারে, কিন্তু এটা অনেকভাবেই আমাদের আশাহত করে। কারণ ব্লগাররা অতীতে নানা রকম উস্কানির শিকার হয়েছেন, অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন।’

বিশ্লেষকগণ মনে করছেন সেকুলারদের এই ক্ষোভ ও হতাশার কারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আস্থা, ভালোবাসা ও নির্ভরতা। কারণ, রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দেশে আওয়ামী লীগই তাদের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সাদেকা হালিমের বক্তব্যে তেমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেলো।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষতার রেটিং-এ এখনো আওয়ামী লীগই এগিয়ে আছে। যারা অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল বা ধর্মনিরপেক্ষ – তাদের বেছে নেবার মত দল খুব সীমিত, তাদের কাছে আওয়ামী লীগই এখনো শেষ ভরসা।’

পূর্ববর্তি সংবাদসোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি পেল ঐক্যফ্রন্ট
পরবর্তি সংবাদকুরআনের ভূমিতে কুরআন পাঠ