নবী-জীবনের আদর্শ: জান্নাতের পথের সূচনা হচ্ছে সত্যবাদিতা : মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ

সুরাতুল আহযাবের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেন, (তরজমা) ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) মাঝে রয়েছে উত্তম অনুসরণ’। অর্থাৎ তিনিই উম্মাহর আদর্শ, তাঁর অনুসরণই কাম্য। ‘তোমাদের জন্য’ মানে তোমরা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশা কর, আখেরাতের নাজাত প্রত্যাশা কর, যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর তাদের জন্য।

এই আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ, তাঁকে উসওয়া হিসেবে গ্রহণ করা ঈমানের প্রধান দাবি। এই দাবি পূরণের জন্য আমাদের নবী-আদর্শ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে। যেন আমরা হতে পারি তাঁর প্রকৃত অনুসারী এবং আদায় করতে পারি তাঁর উম্মত হওয়ার হক।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শ। ইবাদত-বন্দেগী, আকীদা-বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার, আদব-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র- সকল বিষয়ে আদর্শ। আর তা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। কাজেই তাঁর আদর্শের অনুসরণে নিজের কর্ম ও জীবনকে গড়ে তোলা আল্লাহর আদেশ। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব হবে।

আল্লাহর  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন পবিত্র ও নির্মল জীবনের নমুনা, কাজেই জীবনের যে ক্ষেত্রেই তাঁকে অনুসরণ করা হবে, জীবনের ওই ক্ষেত্রটি পবিত্র ও নির্মল হয়ে উঠবে।

জীবনের অনেক অধ্যায়, অনেক অঙ্গন। এক বড় অধ্যায় স্বভাব-চরিত্র। কেউ যদি জীবনের এই অধ্যায়টিকে জ্যোতির্ময় করতে চায় তার কর্তব্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা।

আল্লাহ পাক তাঁর সম্পর্কে এই সনদ দিয়েছেন- ‘নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী, মহান আখলাকের অধিকারী।’

সুতরাং স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার উসওয়ায়ে রাসূলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

আজ  আমরা শুধু একটি বিষয় নিয়ে একটুখানি আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতা। তিনি কেমন সত্যবাদী ছিলেন, সত্যবাদিতার শিক্ষা কত তাকিদের সাথে দিয়েছেন, শুধু শিক্ষাই নয়, সত্যবাদিতার গুণে গুণান্বিত করবার জন্য তাঁর সাহাবীগণকে কীভাবে তারবিয়াত করেছেন, সুন্নাহ ও সীরাতের কিতাবে তা বিস্তারিতভাবে আছে।

তাঁর জীবনের, স্বভাবের এক উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সত্যবাদিতা। নবুওতের আগ থেকেই তিনি তাঁর সমাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন সত্যবাদী ও আমানতদার হিসেবে। আমরা সবাই এই বিষয়টি জানি। এই প্রসিদ্ধি কি একদিনে হয়েছিল? না, একদিনে হয়নি। ভাবমর্যাদা একদিনে গড়ে ওঠে না। তা গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, নানা ঘটনায়, নানা পরিস্থিতিতে। আরবের কুরাইশের মাঝে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর কথা-কাজ, তাঁর আচার-আচরণ সব তাদের সামনে ছিল। তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন তাদের সামনে ছিল। এই দীর্ঘ জীবনে তাঁর কর্ম ও আচরণ থেকে তাঁর সমাজ এই বিশ্বাস গ্রহণ করেছে যে, এই মানুষটি একজন সত্যবাদী, আমানতদার মানুষ।

নবুওতের পূর্বের ঘটনাবলীও আলোচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ঘটনা আপনাদেরও অনেকের জানা আছে। লম্বা আলোচনার সুযোগ নেই। তবে এক দুইটি দৃষ্টান্ত আমরা স্মরণ করতে পারি। সহীহ বুখারীতে একটি অসাধারণ ঘটনা আছে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন প্রথম ওহী নাযিল হল এবং তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন ওই সময় উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রা. যে কথাগুলো বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, তা তাঁর উন্নত কর্ম ও চরিত্রের এক অসাধারণ সনদ। আম্মাজানের কথাগুলো সহীহ সনদে, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রা.-এর কাছে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন-‘আমি আজ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, এতে আমার প্রাণের আশংকা হচ্ছে।’

উম্মুল মুমিনীন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- না, এ হতেই পারে না। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন! আল্লাহ পাক কখনো আপনাকে অপদস্থ করবেন না, (আল্লাহ পাক তো আপনাকে সম্মানিত করবেন,) কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, অন্যের ভার বহন করেন, মেহমানদারী করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ান- (এইসকল গুণের অধিকারী যিনি, তাকে আল্লাহ পাক সম্মানিত করবেন, তাকে তিনি কখনো অপদস্থ করবেন না।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯৮২

এখানে হযরত খাদীজা রাযিআল্লাহু আনহা, যিনি এই মানুষটির সাথে ইতিমধ্যে পনের বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন, তাঁর সনদ-‘আপনি সত্য কথা বলেন।’

আরেকটি দৃষ্টান্ত : দাওয়াতের প্রথম দিকের ওই ঘটনা তো আমাদের সবারই জানা আছে। সাফা পাহাড়ের ঘটনা। সহীহ বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (কুরআন মাজীদে নিকটাত্মীয়দের দাওয়াতের আদেশ নাযিল হওয়ার পর) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, ‘ইয়া সাবাহাহ্!’ অর্থাৎ বিপদ! বিপদ! কুরাইশের লোকেরা পাহাড়ের সামনে উপস্থিত হল। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-

‘আমি যদি তোমাদের বলি যে, একটি শত্রুদল এই পাহাড়ের ওপার থেকে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’

সকলে বলল-‘আমরা আপনাকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখিনি।’

তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন আযাবের আগের সতর্ককারী। …সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯৭১

এই ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। তবে এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তার জাতির সাক্ষ্য-

‘আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি।’

আরেকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি।

ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ানের সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের বিখ্যাত ঘটনা বর্ণনা করেছেন, আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম কবুল করেননি। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে শামে গিয়েছিলেন। শাম ঐ সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, সম্রাট কোনো কারণে শামে অবস্থান করছিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের সংবাদ তার নিকট পৌঁছেছিল। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আরো জানতে চাচ্ছিলেন। তো আদেশ দিলেন, এখানে যদি আরবের কেউ থাকে তাকে আমার কাছে নিয়ে আস, আমি আরবের নবী সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আবু সুফিয়ান শামে ছিলেন, তাকে হিরাক্লিয়াসের সামনে হাজির করা হল। হিরাক্লিয়াস অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল-

‘তিনি নবুওতের দাবি করার আগে তোমরা কি কখনো তাকে মিথ্যাকথনে অভিযুক্ত  করেছ?’

আবু সুফিয়ান বলেন, আমি উত্তরে বললাম,-‘না, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কখনো হয়নি; আমরা তাকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারিনি।’

হিরাক্লিয়াস যে বিষয়গুলো জানতে চেয়েছিলেন সে সম্পর্কে আবু সুফিয়ানের উত্তর শোনার পর তিনি নিজেই একে একে সেই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। সত্যবাদিতা সংক্রান্ত প্রশ্নের ব্যাপারে বললেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা কি তাকে নবুওত দাবির আগে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পেরেছ? তুমি বলেছ, অভিযুক্ত করতে পারোনি। এ থেকে আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি সত্য নবী। কারণ যে ব্যক্তি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা বলেন না, তিনি আল্লাহর ব্যাপারেও মিথ্যা বলতে পারেন না।

পুরো কথোপকথনটি সহীহ বুখারীতে (হাদীস নং ৭) আছে। যে কেউ তা দেখে নিতে পারেন।

এটি হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষ্য, যিনি ওই সময় পর্যন্ত তাঁর প্রাণের দুশমন ছিলেন এবং তার মর্যাদাহানির সুযোগ খুঁজছিলেন।

আরেক আশ্চর্য ঘটনা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র মদীনায় হিজরত করে এসেছেন, বদরের যুদ্ধের আগের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। মদীনার নেতৃস্থানীয় সাহাবী হযরত সা‘দ ইবনে মুআয রা. উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। মক্কা-মদীনার মাঝে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল, আসা-যাওয়া ছিল, তাদের মাঝে পরিচয়ও ছিল। সা‘দ ইবনে মুআয রা. যখন মক্কায় যেতেন তখন মক্কার সরদার উমাইয়া ইবনে খালাফের বাড়িতে মেহমান হতেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ যখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে শামের দিকে যেত, তখন মদীনায় এলে সা‘দ ইবনে মুআয রা.-এর বাড়িতে মেহমান হত। জাহেলী যুগ থেকেই এটা ছিল। তো সা‘দ ইবনে মুআয রা. উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় গিয়েছেন, কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করতে হবে। কিন্তু কা‘বা চত্বরে গিয়ে তাওয়াফ করবেন কীভাবে? তাঁরা মদীনার মুসলিম। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরামকে আশ্রয় দিয়েছেন। মক্কার কাফির নেতাদের চোখে তো এরা বড় অপরাধী! উমাইয়া ইবনে খালাফ বলল, অপেক্ষা করুন, দুপুরবেলায় প্রখর রৌদ্রের কারণে লোকজন কা‘বার চত্বরে থাকে না, নিজ নিজ ঘরে থাকে। ওই সময় কা‘বা চত্বর ফাঁকা থাকে, তখন আপনি গিয়ে তাওয়াফ করে আসবেন। সা‘দ ইবনে মুআয রা. সেভাবেই দুপুরবেলা তাওয়াফ করতে বের হলেন। গিয়েছেন নিরিবিলি তাওয়াফ করবার জন্য, তাওয়াফ করছেন, এমতাবস্থায় দেখা হয়ে গেল একেবারে আবু জেহেলের সাথে।

আবু জেহেল সা‘দ ইবনে মুআয রা.-কে দেখে বলে উঠল-‘কে রে এখানে কা‘বার তাওয়াফ করে?’

সা‘দ ইবনে মুআয রা. বললেন- ‘আমি সা‘দ।’

আবু জেহেল বলল, ‘উত্তেজিত হয়ে- বাহ! কী নিরাপদে কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করছ! অথচ তোমরা মদীনার লোকেরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তার সঙ্গীদের আশ্রয় দিয়েছ!’

এভাবে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। উমাইয়া ইবনে খালাফ সা‘দ ইবনে মু‘আয রা.-কে থামাতে চেষ্টা করে আর বলে- ‘সা‘দ! আবুল হাকামের আওয়াজের উপরে তোমার আওয়াজ উচুঁ করো না। তিনি এই মক্কা উপত্যকার সরদার! একটু আস্তে কথা বল। আস্তে কথা বল।’

কয়েকবার যখন উমাইয়া হযরত সা‘দ রা.-কে থামাবার চেষ্টা করল, সা‘দ রা. বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হয়ে উমাইয়া ইবনে খালাফকে লক্ষ করে বললেন- ‘এখন আবুল হাকামের পক্ষ নিচ্ছ? কুফরের এই নেতার পক্ষে ওকালতি করছ?  এই পথে তোমার পরিণাম কী হবে সেটা চিন্তা করেছ? আমি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনেছি যে, তিনি তোমাকে হত্যা করবেন।’

এই কথা শুনে উমাইয়া ইবনে খালাফ আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠল-‘আমাকে?’

সা‘দ ইবনে মুআয রা. বললেন, হাঁ। তখন উমাইয়া ইবনে খালাফের আতঙ্কিত বাক্য- ‘ওয়াল্লাহ! মুহাম্মাদ যখন কিছু বলেন তা মিথ্যা হয় না।’

উমাইয়া অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়ি এসে বউকে বলল, শুনেছ, আমার ইয়াসরিবী ভাই কী বলেছে? বউ বলল, কী বলেছে? উমাইয়া বলল, সে নাকি মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতে শুনেছে যে, তিনি আমাকে হত্যা করবেন। একথা শুনে স্ত্রীও বলে উঠল- ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলেন না।’ (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৬৩২)

আপনারা যদি বদরের যুদ্ধের ঘটনা পড়ে থাকেন তাহলে লক্ষ করেছেন যে, বদরের যুদ্ধের সময় মক্কার সর্দারেরা যখন মুসলমানদের শেষ করার জন্য প্রচণ্ড দর্পের সাথে মক্কা থেকে বের হচ্ছিল তখন উমাইয়া ইবনে খালাফের স্ত্রী স্বামীকে বলল, তুমি কি ভুলে গেছ, তোমার ইয়াসরিবী ভাই কী বলেছিল?’ স্ত্রীর এই কথা উমাইয়ার মনে এতই প্রভাব বিস্তার করল যে, সে নানা ফন্দি-ফিকির করতে লাগল, কোনোভাবে যদি বদরের ময়দানে না যাওয়া যায়, কোনোভাবে যদি এড়িয়ে যাওয়া যায়। অন্যরা বের হয়েছে, সে এই আসছি, এই বের হচ্ছি ইত্যাদি বলে ঘরে বসে আছে, সবাই যখন বের হয়ে গিয়েছে তখন আবু জেহেল দেখে, উমাইয়া ঘরে বসে আছে। সে এসে তাকে লজ্জা দিল, উত্তেজিত করল। নানা কথা বলার পরে উমাইয়া উত্তেজিত হয়ে মক্কা থেকে বের হল। কিন্তু বের হলেও সঙ্গে নিল দুইটা সওয়ারি- একটাতে সে সওয়ার, আরেকটা সঙ্গে খালি। যেখানেই কাফেলা যাত্রাবিরতি করে, উমাইয়া পেছনে পেছনে থাকে এবং দ্বিতীয় সওয়ারিটা প্রস্তুত রাখে। কোনো বিপদ হলেই, যেন তাজাদম সওয়ারিতে লাফিয়ে চড়ে সোজা মক্কায় ফিরতে পারে।

কিন্তু মানুষ যতই ব্যবস্থা নিক, আল্লাহর ফয়সালা রদ করতে পারে না। দেখুন উমাইয়াও ঘরে বসে থাকতে পারেনি। সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে, মৃত্যুর আশঙ্কা করেছে, মৃত্যু থেকে পলায়নের ব্যবস্থাও নিয়েছে, কিন্তু এরপরও পায়ে পায়ে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে গেছে।

বদরের ময়দানে অধিকাংশ কাফির নেতার ধ্বংস হওয়াই ছিল আল্লাহর ফয়সালা। কাজেই ধ্বংসের জন্য তাদের এখানে আসতেই হবে। আল্লাহ পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন, ওরাও প্ররোচিত হয়ে দর্পভরে নিজেদের ধ্বংসের দিকেই ছুটে গিয়েছে। চিন্তা করলে আল্লাহর নাফরমানদের জন্য কত বড় শিক্ষা আছে এখানে!

বলতে চাচ্ছি , রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতার ব্যাপারে, তাঁর যবানে মোবারক থেকে বের হওয়া প্রতিটি বাক্যের ব্যাপারে তাঁর দুশমনেরও বিশ্বাস কীরূপ ছিল! এই তাঁর সীরাত; তাঁর জীবনটি এভাবেই কেটেছে; তাঁর কথা ও কাজ এমন ছিল যে, তাঁর জাতি তাঁর সত্যবাদিতার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিঃসংশয় ছিল। মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য, প্রিয়নবীর এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের চেষ্টা করা।

সত্যবাদিতা যাঁর জীবনে এই রকম প্রোজ্জ্বল ছিল তিনি সত্যবাদিতার ফযীলত বয়ান করেছেন এভাবে-

‘সত্যবাদিতা পরিচালিত করে ভালো কর্মের দিকে। আর ভালো কর্ম জান্নাতের দিকে। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদিতা পরিচালিত করে মন্দ কর্মের দিকে আর মন্দ কর্ম জাহান্নামের দিকে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৯৪

তাহলে পথ দুইটি : জান্নাতের পথ আর জাহান্নামের পথ। জান্নাতের পথের সূচনা হচ্ছে সত্যবাদিতা। আর জাহান্নামের পথের সূচনা মিথ্যাবাদিতা। এখন পথিকের ইচ্ছা সে কোন্ গন্তব্য অবলম্বন করবে এবং কোন্ পথে চলবে।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত ও অনুসারী হিসেবে আমাদের কর্তব্য, জীবনের সকল ক্ষেত্রে সত্যবাদিতাকে অবলম্বন করা। তিনি নিজেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী আর তাঁর শিক্ষা ও সাহচর্যে গড়ে উঠেছিল সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠদের এক মহান জামাত-সাহাবায়ে কেরাম।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এই মহান গুণ অর্জন করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

বয়ান থেকে অনুলিখন : আনাস বিন সা‘দ

পূর্ববর্তি সংবাদসরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনে যাওয়া : ফখরুল
পরবর্তি সংবাদগাজায় অস্ত্রবিরতির প্রতিবাদে ইসরাইলি মন্ত্রীর পদত্যাগ