ভারতের ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রামের মধ্যে ৭ হাজারেরও বেশি প্রসিদ্ধ গ্রামের নাম রাখা হয়েছে হিন্দু দেবতা রাম এবং কৃষ্ণার নামে। এর বিপরীতে শুধু ২৩৪টি গ্রামের নাম রয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের নামে।
কথায় আছে নামে কী যায়-আসে? কিন্তু ভারতে নামে অনেক কিছু যায়-আসে। অন্তত ভারতীয় শহর ও গ্রামের নাম পরিবর্তনের প্রবণতা থেকে তাই মনে হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে শতাধিক জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি প্রসিদ্ধ ও বড় শহরও রয়েছে। যেমন, বোম্বে থেকে মোম্বাই, মাদরাজ থেকে চেন্নাই করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের পরিবর্তন করা নাম পুনর্বহাল এবং নতুন করে দেয়া নাম পরিবর্তন করা হয়েছে এ সময়। পূর্বে এসব নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি ছিল নিজেদের ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ভাষাগত পরিচয় ও জাতীয়তা রক্ষা। কিন্তু এখন নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠিকে সন্তুষ্ট করার জন্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নাম বদলের নতুন ধারার প্রবর্তক। বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ থেকে যার শুরু । গত জুলাই মাসে উত্তরপ্রদেশের শাসক যোগী আদিত্যনাথ ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত রেল স্টেশন ‘মোগল সরাইয়ে’র নাম পরিবর্তন করে ‘দীন দয়াল উপাধ্যায়’ নামকরণ করেন।
অক্টোবরে উত্তর প্রদেশের ‘এলাহবাদ’ শহরের নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘পরাগ রাজ করা’। উদ্দেশ্য হিন্দু তীর্থস্থানের সাথে নাম মিলিয়ে প্রাচীন পরিচয় ফিরিয়ে আনা। ভারতের বিখ্যাত এই শহর তিন নদীর মোহনায় অবস্থিত। হিন্দু ধর্মমতে যা একটি পবিত্রস্থান। তাই তার নাম রাখা হয়েছে পরাগরাজ।
কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট হলো না বিজেপি সরকার । তাদের মনে ঝাল অনেক। মুসলিম শাসকের দেয়া ৪৩৫ বছরের পুরোনো ‘ফয়জাবাদ’ নামটি পরিবর্তন করে ‘অযোধ্যা’ করে দিয়েছে যোগী আদিত্যনাথ সরকার। রামের জন্মস্থানকে অযোধ্যা বলা হয়। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় কট্টরপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয়। যে ঘটনার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়।
এবার বিজেপির চোখ পড়েছে তাজমহলের শহর আগ্রা ও গুজরাটের রাজধানী আহমদাবাদের উপর। তারা এ শহর দুটিরও হিন্দু নাম দিতে চায়। কয়েক বছর আগে বিজেপি শাসকরা রাজস্থানের তিনটি গ্রামের নাম পরিবর্তন করে নামগুলি শুধু ইসলাম সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে।
মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দু পরিচায়ক নাম দিয়ে ভারত সরকার ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও পরিচিতির ওপর তাদের বিদ্বেষের চিত্রটাকেই প্রকাশ্য করে তুলেছে।মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে এভাবে নাম পরিবর্তন এবং এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরব সম্মতি ভারতের চলমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিটাকে আরো উস্কে দিচ্ছে। ধ্বংস করছে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও পরিবেশ ।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গগন প্রিত সিং বলেন, ভারতে নাম পরিবর্তনের রাজনীতি দেশের সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মাত্র।
২০১৪ সালে মোদি সরকার মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর সড়কের নাম পরিবর্তন করে ভারতের মিসাইলম্যান খ্যাত এপিজে আবদুল কালাম সড়ক করেছে।
এটা বোঝা কঠিন যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা কেন মনে করছে যে সমাজে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নেই অথবা বিজেপি কেন তাদের ‘মজলুম সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মনে করে।
ভারতের ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রামের মধ্যে ৭ হাজারেরও বেশি প্রসিদ্ধ গ্রামের নাম রাখা হয়েছে হিন্দু দেবতা রাম এবং কৃষ্ণার নামে। এর বিপরীতে শুধু ২৩৪টি গ্রামের নাম রয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের নামে।
সমালোচকদের দাবি, ভারতে মুসলিম নাম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মনোবল ও স্বাধীনতার অনুভূতি নষ্ট করা এবং জাতির ইতিহাস থেকে তাদের অবদান মুছে ফেলা।
ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বলেন, ‘রাজনীতির আক্রমণটা ইতিহাসের উপরই প্রথমে হয়।’
ভারতের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস বাকি থাকতে বিজেপির পক্ষ থেকে নাম পরিবর্তনের এসব তোড়জোড় হিন্দু ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণেরই চেষ্টা মাত্র। গত মার্চে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র আদালতে বলেছেন, তারা বিভিন্ন প্রদেশের একাধিক গ্রাম, বাজার ও রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন। যার অধিকাংশ বিজেপি শাসিত হরিয়ানা ও রাজস্থান প্রদেশের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নাম পরিবর্তন ভোটের হিসেবে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারে না। পরিবর্তন আনতে পেরেছে এমন প্রমাণও ভারতের রাজনীতিতে নেই। নাম পরিবর্তন মানুষের আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জনের বিবেচনায় সামান্যই ভূমিকা রেখে থাকে। তবুও বিজেপি সরকার নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী।
বিদেশি নিউজসাইট অবলম্বনে আবরার আবদুল্লাহ
