ভারত : ইতিহাসের পথ বেয়ে

নাঈম বিন মাসউদ ।।

এক. বারাস ও সিঙ্গুল: নয়জন আম্বিয়া আলাইহিস সালামের কবর!

সিরহিন্দ থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরে ভারতের সুবিখ্যাত বারাস অধ্যুষিত অঞ্চল অবস্থিত। এখানে নয়জন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের কবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ নবীগণ কওমে নুহ ও কওমে আ’দের মাঝামাঝি সময়ে এসেছিলেন।

তবে এসব তথ্যের ধর্মীয় বা ভৌগলিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেবল লোকমুখেই এসব ইতিহাস প্রচলিত হয়ে আসছে।

বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, সিরহিন্দ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিঙ্গুল নামে একটি শহর ছিল। আম্বিয়া আলাইহিস সালাম এ সিঙ্গুল থেকে দাওয়াত দেয়া শুরু করেন। কিন্তু এলাকার পাপিষ্ঠ লোকজন নবীদের অবমাননা করলে আসমান থেকে পাথর বর্ষিত হয়। পুরো জনপদকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।

বর্তমানে সেখানের বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন এ কথার নিদর্শন বহন করে। দেশভাগের সময় এ কবরগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে। ফলে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘকাল এ অবস্থায় থাকার পর শিখ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ জানতে পারেন, এখানে মুসলমানদের কয়েকজন মহান ব্যক্তি শুয়ে আছেন। তখন তারা এর পরিচর্যা নেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এখানে বিদআতের সকল কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়।

বর্তমানে কবরগুলোর পাশে রয়েছে বিশাল মসজিদ ও মাদরাসা। দেওবন্দের ওলামায়ে কেরাম বর্তমানে এ মসজিদ মাদরাসা পরিচালনা করেন।

 

দুই. রায়পুর খানকাহ, যেথায় ঈমানের আগুন জ্বলে

রায়পুর সাহরানপুর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সবুজ-শ্যামল নয়নাভিরাম দৃষ্টিনন্দনে দর্শকের মন জুরিয়ে আসে। অস্থির অন্তর নির্মল বাতাসে প্রশান্তি লাভ করে। নদীর পাড় ঘেঁষে বাগ-বাগিচার মাঝে সবুজের ছায়াঘেরা, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থান হওয়ার কারণে এর নৈসর্গিক আকর্ষণ খানকাহর মুরিদদের জন্য অত্যন্ত মনোরম। এখনো সে  সৌন্দর্যের মায়াবি ছোঁয়া রয়েছে।

উনবিংশ শতাব্দীতে এ রায়পুর খানকাহ পশ্চিম পাঞ্জাবের দীন ও হেদায়েতের একটি মারকাজ ছিল। পুরো ভারতবর্ষের জন্য ছিল রহমতের ফোয়ারা। হজরতে আবদুর রহীম ও শাহ আবদুল কাদের রহ. এর অক্লান্ত মেহনত আর অপরিসীম মুজাহাদার ঘাঁটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল এ খানকাহ।

এ খানকাহর বর্তমানে দায়িত্বশীল মাওলানা আবদুল কাইয়ূম। তিনিও সিলসিলা অনুযায়ী  মজলিস চলাকালে অধিকাংশ সময় চুপ করে থাকেন। কখনো কখনো দু’একটি কথা বলেন।

 

তিন. দিল্লি কলেজ

দিল্লি­ কলেজ। আজ আমরা যাদের নাম নিয়ে গৌরবান্বিত হই, যাদের নাম শুনে আমরা ইসলামের চেতনা খুঁজে পাই, তাদের অনেকেই ছিলেন দিল্লি কলেজের শিক্ষার্থী।

মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতাভি, দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইয়াকুব নানুতাভি, মাযাহিরুল উলুম সাহরানপুর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মাযহার নানুতাভি, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমাদ খানসহ সময়ের বিখ্যাত মনীষীরা এখানে থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। এরাই বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের নেতৃত্বেই এ ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে।

এ দিল্লি­ কলেজ ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।  এ কলেজ তখন মোঘল রাজার তত্ত্ববধানে পরিচালিত হতো। এ প্রতিষ্ঠানে হিন্দুদের জন্যও শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো। অবশ্য তৎকালীন সময়ের জন্য এ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ছিল। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান সবার একই শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কারো মাঝে পার্থক্য তৈরী করা হতো না। হিন্দুদের ধর্মীয় শিক্ষার আলাদা পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থাও ছিল। ফলে এখানে ছিল হিন্দু-মুসলমানে জন্য সৌহার্দময় অনুকুল পরিবেশ।

তবে আশ্চর্য তথ্য হলো, বৃটিশশক্তি দিল­ দখল করার পর এ সুবিখ্যাত কলেজ ১৮৫৭ সালে বন্ধ করে দেয়। ১৮২৪ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩২ বছরে এ কলেজ বিশ্বকে যা উপহার দিয়েছে শত বছরেও কোনো প্রতিষ্ঠান দিতে পারবে না।

এখানে একটি নাম উল্লেখ না করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। মাওলানা মামলুক আলী  হলেন এমনই একজন ব্যক্তি যিনি হাজারো ছাত্র থেকে বাছাই করে করে মনি-মুক্তা হিরা-জহরত বের করতে জানতেন। উপরে উলি­খিত সকল মনীষী এ পরশ পাথরের ছোঁয়ায় ধন্য হয়েছেন।

 

চার. নাগ আবাদ: ‘ফাতওয়ায়ে আলমগীর’ এর রচনাস্থান

নাগ আবাদ দক্ষিণ ভারতের অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক জায়গা। বর্তমানে এটি ভারতের অন্যতম ব্যবসা ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।

শাইখুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এ জায়গাকে ভারতের কর্ডোভা ও গ্রানাডা বলেছেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করা অসংখ্য ঐতিহাসিক ভবন এখানে রয়েছে। মুঘল বাদশাহ আলমগীরের স্ত্রী রাবেয়া দিগরানীর কবর এখানে এবং তাকে কেন্দ্র রয়েছে ভারতের আরেকটি তাজমহল।

ইলম ও আমলের ফোয়ারা হিসেবে বিখ্যাত এ জায়গাটি এক সময় সুলতান মুহাম্মাদ তুঘলকের আমলে দারুল হুকুমত হিসেবেও কাজ করা হতো। খাজা নিজামুদ্দিন শেষ জীবনে দক্ষিণ ভারতে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রায় সতশত বুযুর্গানে দীনের একটি কাফেলা প্রেরণ করেছিলেন। তাদের অনেকেই এখানে শায়িত আছেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর-এর কবরও এখানে। যিনি বিশ্বের কাছে বাদশাহ আলমগীর নামে অধিক পরিচিত। তাকে মিসরের প্রখ্যাত আলেমেদীন ও সাহিত্যিক শায়েখ আলী তানতাভী ষষ্ঠ খলিফায়ে রাশেদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বাদশাহ আলমগীর রহ. ছিলেন বাদশাহ শাহজাহানের পুত্র। তিনি ৪ নভেম্বর ১৬১৮ সালে জম্মগ্রহণ করেন। ১৬৫৯ থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত তিনি মুঘল রাজত্ব পরিচালনা করেন। ইন্তিকাল করেন ১৭০৭ সালে। তিনি  ষষ্ঠ মুঘল বাদশাহ ছিলেন।

শহরে বিশাল জামে মসিজিদ রয়েছে। মসজিদের বারান্দ খুবই প্রশস্ত। বারান্দার চারিদিকে আলাদা আলাদা হুজরা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব হুজরাগুলো ওলামায়ে কেরামের কাছে ফিকহের প্রতি বাদশাহর ভালোবাসার মূর্তমান প্রতিক।  এ হুজরাতেই বাদশাহ আলমগীর-এর তত্বাবধানে সে সময়ে সুবিজ্ঞ ফুকাহায়ে কেরাম ফাতওয়ায়ে আলমগীরি সংকলন করেন

 

তথ্যসূত্র:

১. উইকপিডিয়িা

২. ভারতে একটি দাওয়াতি সফর: মাও. ইসা মানসূরী

৩. সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভিতর-বাহির: জয়নাল হোসেন

 

পূর্ববর্তি সংবাদআফগানিস্তানে মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে নিহত ২৬
পরবর্তি সংবাদনির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে: খেলাফত মজলিস