মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের ওপর কেন ক্ষুব্ধ অনেকেই?

রাশেদুজ্জামান খান ।।

দেশের সিংহভাগ উলামায়ে কেরামকে এড়িয়ে ভিন্নপথে চলার জন্য বরাবরই আলোচিত মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। দেশের উলামা বিদ্বেষী কথিত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার সখ্য, কিছু বিষয়ে উলামা-আসলাফের মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য প্রদানসহ নানাবিধ প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা নিয়ে চলতেই যেন পছন্দ করেন তিনি।

২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্যানারে দেশের তাওহিদি জনতার জাগরণ ঘটলে তিনি ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান গ্রহণ করেন। ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের প্লাটফর্ম শাহবাগে গিয়ে তাদের সমর্থন দান করেন। মূলত তখন থেকেই উলামায়ে কেরামের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ নেয়।

৫ মে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে মর্মান্তিক ঘটনার পরও তার অবস্থান ছিল আক্রান্তদের বিপক্ষে। তিনি সেই শাপলা-যজ্ঞের প্রতিবাদ না করে সেখানে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন খুঁজে বেড়িয়েছেন এবং শাপলা চত্ত্বরে শান্তি সমাবেশ করেছেন। যা থেকে প্রমাণিত হয় হেফাজতের জমায়েতটি ছিল অশান্তি সৃষ্টির জন্য।

সম্প্রতি টঙ্গীর ইজতেমার মাঠে সাধারণ মুসল্লি ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপর ভারতের বিতর্কিত তাবলিগি মুরব্বি মাওলানা সাদের অনুসারীদের পেছনে ইন্ধনদাতাদের তালিকায় বার বার মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাউসদের নামটি উচ্চারিত হচ্ছে।

যারা তাকে এ ট্রাজেডির নেপথ্য নায়কদের অন্তর্ভূক্ত করছেন, তাদের কয়েকটি জোরালো যুক্তি রয়েছে। যেমন, হামলার আগে তার পরিচালিত জামিয়া ইকরার মসজিদে (খিলগাঁও চৌধুরিপাড়া ঝিল মসজিদ নামে পরিচিত) সাদপন্থীদের জোড় করা এবং ফজরের আগে সেখান থেকে বাসভরে টঙ্গীর মাঠে যাওয়া। হামলার আগের দিনের জোড়গুলো যে খুব স্বাভাবিক কোনো আমল ছিলো না তা বুঝতে মহাপণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। হামলা পরিকল্পনার কিছু যে সেখানেও হয়নি সেই নিশ্চয়তাও বা কে দিবে?

শুধু টঙ্গীর মাঠ দখল নয়; বরং কয়েক মাস আগ থেকে যখন উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মাওলানা সাদের অনুসারীদের বিরোধ স্পষ্ট হতে শুরু করে এবং সাদপন্থীরা উলামায়ে কেরামের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে তখন থেকে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাদপন্থীদের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় তার সম্পাদিত একটি পোর্টালে সাদপন্থীদের পক্ষে মতামত, বিবৃতি ও সংবাদ প্রচার শুরু হয়। অন্যদিকে মাওলানা সাদের বিভ্রান্তির ব্যাপারে সোচ্চার আলেমদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ও অশ্লীল হয়ে ওঠে তার অনলাইন পোর্টালটি।

তবে রহস্যজনক কারণে তিনি তার অবস্থানে খুব বেশি দিন স্থির থাকেননি। তিনি কখনও বলেছেন, আমি দেওবন্দের অবস্থানের সঙ্গে আছি। আবারও কখনও মাওলানা সাদের পক্ষাবলম্বন করে বলেছেন, ভুল তো সবারই হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসিন মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরিরও অনেক মারাত্মক ভুল আছে। কিন্তু আমরা তা বলে বেড়াই না। আবারও কখনও বলেছেন, মাওলানা সাদের কিছু ভুল আছে, তবে তা এমন পর্যায়ের না যার জন্য তাকে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হবে। তিনি এই-ও বলেছেন, দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে কোনো ফতোয়া দেয়নি; বরং মতামত ব্যক্ত করেছে।

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ উলামায়ে কেরামের দাবি প্রত্যাখান করে বলেন, ‘বলা হয়, মাওলানা সাদের পক্ষে কোনো আলেম নেই। নিজামুদ্দিনে অনেক আলেম আছেন। আলেমদের মাধ্যমে তা চলছে।’ বরং তিনি তাবলিগ জামাতের আলমি শুরার আমির হাজি আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেছেন, পাকিস্তানের তাবলিগ জামাত আলেম ছাড়া চলছে।’ অথচ হাজি আবদুল ওয়াহাব রহ. সব সময় আলেমদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের পরামর্শক্রমে কাজ পরিচালনা করেছেন। আলেমদের দীর্ঘ সংশ্রবে ছিলেন তিনি।

মাওলানা মাসউদ সাদপন্থীদের সঙ্গে আলেম আছে দাবি করলেও সাদপন্থী আলেম মাওলানা আশরাফ আলী অবশ্য টিভি টকশোতে বলেছেন, আলেম নয়, আওয়াম (সাধারণ মানুষ) রয়েছে তাদের সাথে।

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ উলামায়ে কেরামকে তাবলিগ বিষয়ে তৃতীয়পক্ষ ও বহিরাগত বলে অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তার দাবি হলো, উলামায়ে কেরামের হস্তক্ষেপের আগে তাবলিগের কাজ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল। তৃতীয়পক্ষ (উলামায়ে কেরাম) সেখানে হস্তক্ষেপ করার পর অশান্তি তৈরি হয়েছে। তাহলে কি তিনি পুরো বিবাদ-বিশৃংখলার দায় আলেমদের উপর চাপালেন না? অথচ তিনি নিজেও তাবলিগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি না হয়ে তাবলিগ বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন নিয়মিতভাবে।

তিনি উলামায়ে কেরামের উপর দোষ চাপিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। বিশ্বের অন্য কোথাও মাওলানা সাদের আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না।’
সম্প্রতি তিনি মাওলানা সাদের পক্ষপাত করে বলেছেন, ‘সুফি মানসুর হাল্লাজের মতো মাওলানা সাদ ‘মাগলুবুল হাল’ (নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই এমন ব্যক্তি)।’ সুতরাং তার ভুল গণ্য করা যাবে না।

মাওলানা সাদের পক্ষপাত করলেও মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সম্প্রতি এক টিভি টকশোতে বলেছেন, মাওলানা সাদের সবকিছু তিনি জানেন না এবং সব কিছু পড়ে দেখেননি। তাহলে তিনি কেন বার বার মাওলানা সাদের পক্ষাবলম্বন করছেন?

শুধু তিনি নন; তার অনুসারীদের অনেকেই মাওলানা সাদের পক্ষে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তৎপরতা চালাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার এমন ব্যক্তিরা খেয়াল করে থাকবেন যে, এমন কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি আছেন যারা একইভাবে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ও মাওলানা সাদ কান্ধলভির পক্ষে সরব।

টঙ্গীর ইজতেমার ময়দানের এই সংঘাতের সূত্র মনে করা হয় গত ১৫ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত তাবলিগ বিষয়ক বৈঠককে। কারণ, এই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তই আইনিভাবে তাবলিগের দুটি পক্ষকে সমান্তরাল অবস্থানে নিয়ে আসে। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় নির্বাচনের আগে জোড় ও ওয়াজাহাতি জোড় বন্ধ থাকবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বৈঠকে তাবলিগ জামাতের আলেম উপদেষ্টা কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ আরেকজন আলেম অংশগ্রহণ করেন। বাকি সদস্যরা অভিযোগ করেন তারা আমন্ত্রণ পাননি। বৈঠকের পর অপর আলেম সদস্য তিনি পরিস্থিতির স্বীকার বলে ওজর পেশ করলেও মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ এই বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজনই মনে করেননি। তাতে অনেকের ধারণা এই বৈঠকের উদ্যোক্তা হয়তো তিনিই ছিলেন।

সুতরাং টঙ্গীর ইজতেমার মাঠে সাদপন্থীদের হামলার পর মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের প্রতি সব মহলের আলেম ও আলেম-অনুসারী তাবলিগি সাথীদের যে ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে তা শুধু একদিনের বিষয় নয়; তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নগদ কষ্টসহ তাদের দীর্ঘদিনের পূঞ্জিভূত দুঃখ, ক্ষোভ ও বেদনা।

পূর্ববর্তি সংবাদকাতারের আমিরকে সৌদিতে আমন্ত্রণ জানালো বাদশাহ সালমান
পরবর্তি সংবাদনির্বাচনে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষমতা যাদের কাছে