‘নির্বাচন পূর্ব হামলায় মানুষের মাঝে উৎসবের পরিবর্তে বিরাজ করছে আতঙ্ক’

আতাউর রহমান খসরু ।।

গত ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নামেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরা। অনেকে দীর্ঘদিন এলাকার বাইরে থাকলেও প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রচার কাজে এলাকায় যান। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার একদম শুরু থেকেই সরকার বিরোধী প্রার্থী ও প্রার্থীর কর্মীদের উপর হামলা, প্রচার অফিস ভাংচুর, প্রচার উপকরণ কেড়ে নেয়া এবং তা পুড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিতভাবে। হামলা হচ্ছে ছোট বড় বিভিন্ন দলের প্রার্থীর উপরই।বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরাই বিরোধীদের উপর এই হামলা চালাচ্ছেন এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই মিলছে না তাদের।

প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে সরকারি দল সমর্থক কর্মীরা কেন অন্যদের উপর হামলা করছে? ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন মনে করেন, ‘সরকার জানে জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। আর জনগণের উপর আস্থা নেই বলেই সরকার পেশী শক্তির উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। তারা বিরোধীদের উপর চড়াও হচ্ছে। যেখানেই কোনো প্রার্থীকে তাদের জন্য হুমকি মনে হচ্ছে তার উপরই তারা চড়াও হচ্ছে। প্রচারণার কাজে বাধা দিচ্ছে।’

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের গাজীপুর জেলা সভাপতি ও সহকারী মহাসচিব মুফতি মাউসদুল করীমও একই কথা বলেন। তার বক্তব্য- ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটছে তা অপ্রত্যাশিত। সব প্রার্থী সমান সুযোগ পাওয়ার কথা থাকলেও সবাই তা পাচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার ভয় পাচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে।’

উভয় নেতাই নির্বাচন কমিশন যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না বলে অভিযোগ করেন। মুফতি মাসউদুল করীম বলেন, দেশের জনগণ নির্বাচন চাচ্ছে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন হবে কি না এবং কেমন হবে তা নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সদিচ্ছার উপর। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। নির্বাচন কমিশন বিরোধী দল এবং আক্রান্তদের আশ্বাস দিচ্ছেন। আশ্বাস বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ এখনও দেখছি না। আমরা আশা করবো, তারা তা বাস্তবায়ন করবেন। তাহলে জনগণ তাদের অধিকার পাবে এবং কমিশনের দায়িত্বও পালন করা হবে।

আর এটিএম হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। সারা দেশে হামলা-মামলার মধ্যে তারা নির্লজ্জভাবে বলছে, লেভেল প্লেইং ফিল্ড রয়েছে। তারা সন্তোষ প্রকাশ করছে। বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।’

তিনি নির্বাচন কমিশনকে পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘জায়গায় জায়গায় যেভাবে বিরোধী দলের উপর হামলা চলছে তাতে আপনারা কীভাবে সন্তোষ প্রকাশ করেন? মানুষের ভেতর নির্বাচনী উৎসবের পরিবর্তে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা ভয় পাচ্ছে নির্বাচনের সময় কী হয় তা নিয়ে। জুলুম-নির্যাতন অব্যাহত থাকলে বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

জমিয়তের সহকারী মহাসচিবের কথায়ও এই শঙ্কা প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না। এবারের নির্বাচনও ভোটার বিহীন নির্বাচনে পরিণত হতে পারে। এমনকি প্রার্থীরাও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

আর এক তরফা নির্বাচনের পরিণতি নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির মতো ভোটার বিহীন নির্বাচন হলে দেশে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এটা তারা সামাল দিতে পারবে বলে মনে হয় না।

তিনি সরকারকে পরামর্শ দেন-তারা যেন ভোটারবিহীন এক তরফা নির্বাচনের পথে না হাঁটে। সেটা করলে সরকার ভুল করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার প্রত্যাশা, সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সরকার অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধা সৃষ্টি করবে না। তাহলে নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।

নির্বাচন কমিশন যদি অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ-বিদেশে তার প্রভাব কেমন হতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে উভয় নেতাই মন্তব্য করেন যে, দেশের গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হবে এবং সরকার জনগণ থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এই ক্ষেত্রে জনগণের সহ্যসীমা অতিক্রম করলে তা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না।

তবে উভয় নেতাই মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা রহস্যজনক। তারা বাংলাদেশের সত্যিকার কল্যাণ চান কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন এই দুই নেতা। অধ্যাপক হেমায়েত উদ্দিন স্পষ্ট অভিযোগ করে বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা নিয়ে কী বলবো? ২০১৪ সনে তাদের কথা শুনে মনে হলো সেটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। দুই-তিন মাস সময়ের ব্যবধানে আবার নির্বাচন হবে।কিন্তু এরপর তারা চুপ হয়ে গেলো। আসলে তারা মুসলিম দেশগুলোর কতোটা কল্যাণ চায় তা নিয়ে সংশয় আছে।

আর মুফতি মাসউদুল করীম কিছুটা ইঙ্গিত করে বলেন, গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি আপেক্ষিক। অনেক গ্রহণযোগ্য বিষয়ও গ্রহণ করা হচ্ছে না এবং অগ্রহণযোগ্য বিষয়ও শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করা হচ্ছে।

এমন সহিংস পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের করণীয় বিষয়েও প্রায় একই কথা বলেন দুই ইসলামি রাজনীতিক। মুফতি মাসউদুল করীমের পরামর্শ হলো, বিরোধী দলগুলোর উচিত সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকা। অন্যায় অবিচারের মধ্যেও তারা টিকে থাকতে পারলে তারা জনগণের সহানুভূতি পাবে।

ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা মাঠে থাকবো ইনশাআল্লাহ! জনগণও আমাদের সাথে থাকবে। তারা আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।

পূর্ববর্তি সংবাদঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুতি
পরবর্তি সংবাদশায়েখ হওয়ার গল্প : একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবেই!