রবার্ট বার্টন ব্রেডলি ও ব্যাংশিও ।।
চীন সরকার জাতিগত সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ‘শুদ্ধি ক্যাম্পে’ আটকে রেখেছে। সেখানে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। একইভাবে খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে বাইবেল নিষিদ্ধ করা, ক্রুশ পোড়ানোর ঘটনা, গির্জা ভেঙ্গে ফেলার মতো ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডও সেখানে চলছে। যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিজিংপিংয়ের চীনে রাষ্ট্র অনানুমোদিত ধর্মবিশ্বাসগুলোও এখন চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শিজিংপিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ধর্মভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কারণ, তিনি সু-সংগঠিত ধর্মীয় জনগোষ্ঠিকে দলের জন্য হুমকি মনে করেন।
২০১৬ সালে শিজিংপিং চীনে ধর্ম সংস্কারের ঘোষণা দেয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের মতো ‘বিদেশি’ ধর্ম সংস্কারের দাবি তোলে। তারা ধর্মগুলোকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে চায় যেন তা চীনা সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে আরও সংগতি পূর্ণ হয়।
চলতি বছরের (২০১৮) ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার চাইনিজ রেগুলেশন ফর রিলিজিয়াস এ্যাফেয়ার্সকে সক্রিয় করে তোলে। যাতে মানুষের ধর্মপালনকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। এ সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য স্থানীয় প্রাশসনে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসন চাইলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে পারবে এবং তারা তা ঢেলে সাজাতেও বলতে পারবে।
আরও পড়ুন : চীনে মুসলিম নিপীড়ন : যে কারণে মুখ খুলছে না মুসলিম বিশ্ব
চীন-গবেষক পাত্রিক পুন বলেন, তাদের টার্গেট ধর্ম। বিশেষত চলতি বছর একটি নতুন আইন কার্যকর করে তা ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরকারিভাবে চীনে অনুমোদিত ধর্ম ৫টি। খ্রিস্ট ক্যাথলিক, খ্রিস্ট প্রোটেস্টেইন্ট, ইসলাম, তাওবাদ ও বৌদ্ধ ধর্ম। এর বাইরেও অনেক চীনা নাগরিক দেশীয় সংস্কৃতি ও সংস্কারগুলো আকড়ে আছে। তারা প্রাচীন প্রার্থনা পদ্ধতি ও বিবাহ রীতি অনুসরণ করে। সরকার নিষিদ্ধ ফাল্গুন গং এর অন্যতম।
চীনের কতো শতাংশ মানুষ ধর্মপালন করে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বলা যায়, চীনা জনগণের বৃহদাংশই ধর্মানুসারী।
এএনইউ কলেজ অব এশিয়ার সহযোগী অধ্যাপক বেঞ্জামিন হিলম্যান বলেন, সাম্প্রতিক দমনাভিযান দেখে মনে হচ্ছে, চীনা সরকার মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের তুলনায় ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকেই বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
তিনি আরও বলেন, চীনা সংবিধান মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মপালনকে অনুমোদন করে। অনেক ক্ষেত্রে তা সংরক্ষণও করে। কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বিশেষত পার্টির কাছে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চায়। সেই হিসাবে উইঘুরদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘু –যারা ধর্মীয়ভাবে সংঘবদ্ধ- তাদেরকে রাষ্ট্রের জন্য হুমকি মনে করে। এই কারণে তাদেরকে ‘শুদ্ধি ক্যাম্পে’ রাখা হয়েছে। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এসব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায়।
চীনের ধর্ম বিরোধী অভিযান থেকে বাঁচতে ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা সরকারে সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে প্রোটেস্টেন্ট চার্চগুলো গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন : চীনে গির্জায় গির্জায় অভিযান: উদ্বিগ্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায়
গত মাসে চীন সরকার ও ভ্যাটিকান চার্চ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী চীনের ১০ মিলিয়ন ক্যাথলিক ও তাদের চার্চগুলো ভ্যাটিকান ও রাষ্ট্র যৌথভাবে পরিচালনা করবে। উভয়পক্ষের সম্মতিতেই নিয়োগ পাবেন ক্যাথলিক বিশপ (ধর্মনেতা)। চুক্তিতে আর কোন কোন বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে তা বিস্তারিত জানা যায়নি। সরকার ও ভ্যাটিকান উভয়পক্ষ তা গোপন করছে।
এই চুক্তি ক্যাথলিকদের মনে স্বস্তি ও শঙ্কা দুটিই তৈরি করেছে। কারণ, চীনের ধর্মবিদ্বেষী সরকারের হাতে গির্জা কতোটা নিরাপদ থাকবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে চুক্তির পর চীনের ৬০ মিলিয়ন খ্রিস্টান নাগরিকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রোটেস্ট্যান্টদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। গতমাসেও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের গির্জা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং ক্রুশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ক্রুশের স্থানে চীনের পতাকা ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ছবি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
চীনের ধর্মবিরোধী যুদ্ধের সবচেয়ে নিষ্ঠুর গল্পটি রচিত হচ্ছে জিংজিয়াংয়ে। সেখানে উইঘুর মুসলিম, কাজাক ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। জাতিসংঘের বিবৃতি অনুযায়ী কমপক্ষে ১ মিলিয়ন উইঘুরকে এসব ক্যাম্পে বন্দী করা হয়েছে। ক্যাম্পের সাবেক ও বর্তমান বন্দীদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তাদেরকে উদ্ভট অনেক কাজে বাধ্য করা হয়। যেমন, বর্তমান প্রেসিডেন্টকে ভালোবাসার প্রকাশ এবং জাতীয় সংগীতসহ দেশাত্মকবোধক গান গাওয়া।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বন্দীদের কমিউনিস্ট পার্টির শ্লোগান দিতে এবং দলীয় গান গেয়ে নতুন বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়।
মিস্টার পুন বলেন, ‘তারা বলছে, নাগরিকদের বন্দী করা হয়েছে নিরাপত্তা এবং তাদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা তারা করছে ব্রেনওয়াশ করার জন্য। আপনার গ্রেফতার হওয়ার জন্য এতোটুকু যথেষ্ট যে, আপনি স্থানীয় মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন এবং আপনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। অথবা আপনার কোনো আত্মীয়কে যদি সরকার চরমপন্থী বলে সন্দেহ করে।’
একজন উইঘুর মুসলিম তারিম এবিসি নিউজকে বলেন, এপ্রিলে যখন উইঘুরের কোথাও কোথাও তুষারপাত শুরু হয়েছে তখন আমি ৫০০ মুসলিমকে শুধু কংক্রিটের উপর ঘুমাতে দেখেছি। তাদেরকে ‘আমি কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালোবাসি, আমি শিজিংপিংকে ভালোবাসি’ গান গাইতে বাধ্য করা হচ্ছিল।
আরও পড়ুন : পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখেছে চীন
শিজিংপিংয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর শহরাত জাকির আন্তর্জাতিক সমালোচনার উত্তরে বলেন, কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চীনের ইতিহাস ও আইন শিক্ষা দিচ্ছে। তাদেরকে আধুনিক জীবন শিক্ষা দিচ্ছে। যেন তারা ভবিষ্যতে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়।
হিলম্যান মনে করেন, জনগণকে হেনস্থা করে, তাদের অধিকার নষ্ট করে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য ও দায়িত্ববোধ বাড়ানো সম্ভব হবে না। বরং তা তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করবে। যা তাদেরকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের বার্তা দিবে। তাতে রাষ্ট্র ও তার নিরাপত্তা উল্টো হুমকির মুখে পড়বে। চীনের মনে রাখা উচিত, মানুষের প্রতিরোধ বিন্দু ও রেখাহীন। যখন তাকে এক লাইন থেকে ফেরানো হয়, তখন অন্য লাইনে সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। (সংক্ষেপিত)
-এবিসি নিউজ থেকে আবরার আবদুল্লাহ-এর অনুবাদ
