২ জানুয়ারি : স্পেনে মুসলিম শাসনের শেষ দিন

৭১১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের মাটিতে পা রাখেন মুসলিম বাহিনী। মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনের অত্যাচারী রাজা রডারিককে পরাজিত করে মুসলমানরা এই ভূখণ্ডে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। মুসলিম আগমনের এক দশকের মধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপের (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) অধিকাংশ ভূখণ্ডই তাদের অধীনে চলে আসে। এরপর সাতশো বছরের বেশি সময় মুসলমান এই ভূখণ্ড শাসন করে।

খিস্টীয় নবম শতকে আন্দালুস হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর অঞ্চল। এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ লোকই ইসলাম ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এর রাজধানী কর্ডোভা ছিলো মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান।

১০৩১ খ্রিস্টাব্দে ঈসায়ীতে উমাইয়া শাসনের পতন হলে আল-আন্দালুস অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পরে। ক্ষুদ্র এই রাজ্যগুলো তাইফা নামে পরিচিত ছিলো। ক্ষুদ্র এই রাজ্যগুলো দুর্বল এবং একতাবদ্ধ না থাকার কারনে ধীরে ধীরে উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। পরবর্তী দুইশত বছরের মধ্যে খ্রিস্টান আগ্রাসনে একেএকে এই রাজ্যগুলোর পতন ঘটতে থাকে। ১২৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণের একমাত্র গ্রানাডা ছাড়া বাকি সবগুলো রাজ্য মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

১২৩৬ সালে কর্ভোভার পতনের পর, গ্রানাডার শাসকেরা উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্টাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুসারে, বার্ষিক কর প্রদানের ভিত্তিতে গ্রানাডা নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ, গ্রানাডা স্বাধীনভাবে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যকে কর প্রদান করতে বাধ্য ছিলো।

এই চুক্তির মাধ্যমে গ্রানাডার শাসকরা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে বরং তাদের শত্রুদের হাতকেই অধিক শক্তিশালী করে। এছাড়াও গ্রানাডার স্বাধীনভাবে টিকে থাকার আরো একটি কারণ ছিলো তার ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষি্ণ স্পেনের সিয়েরা নেভদার পাহাড়ী অঞ্চলে রাজ্যটি অবস্থিত থাকার কারণে এখানে সেনা অভিযান পরিচালনা ছিলো কঠিন। সামরিক দিক হতে ক্যাস্টাইলের থেকে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সিয়েরা নেভদার পাহাড় গ্রানাডার প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছিলো।

যদিও ২৫০ বছরের অধিক গ্রানাডা খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যের করদ রাজ্য হিসেবে তার আবস্থান টিকিয়ে রাখে, কিন্তু চারপাশের বৈরী খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর অবস্থানে সবসময়ই তার স্বাধীনতা হারানোর আশংকায় ছিলো। ১৪০০ শতকের একজন মুসলিম পণ্ডিত আল-আন্দালুসের এই শেষ অবস্থান সম্পর্কে লেখেন, ‘দিন-রাত গ্রানাডার অধিবাসীরা বিশাল সমুদ্র ও তাদের প্রতি বৈরী বিশাল সেনাবাহিনী দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে।’

১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরাগনের রাজা ফারডিন্যান্ড ক্যাস্টাইলের রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে আইবেরীয় উপদ্বীপের দুইটি শক্তিশালী খ্রিস্টান রাজ্য একত্রিত হয়। এই ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তি আন্দালুসের মাটি থেকে সর্বশেষ মুসলিম রাজ্যটির স্বাধীন শাসনের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তির সাথে গ্রানাডার সংঘর্ষ শুরু হয়। সামরিক দিক হতে পিছিয়ে থাকা স্বত্ত্বেও গ্রানাডার অধিবাসীরা অসম্ভব সাহসিকতা্র সাথে লড়াই করে। আন্দালুসের সর্বশেষ অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাধারন মুসলিম জনগন এবং সৈন্যবাহিনী চরম সাহসিকতার লড়াই করলেও তাদের শাসকেরা সেরূপ সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি।

যুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় খ্রিস্টান সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ ছিলো। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না। অন্যদিকে, গ্রানাডায় মুসলিম শাসক ও প্রশাসকরা পারস্পরিক ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলো। তাদের মধ্যে আবার অনেকেই অর্থের বিনিময়ে খ্রিস্টান শক্তির পক্ষে কাজ করছিলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় গ্রানাডার আমির আবুল হাসানের পুত্র মুহাম্মদ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

রাজা ফারডিন্যান্ড এই সুযোগকে তার কাজে লাগান। তিনি মুহাম্মদকে তার পিতা এবং পরবর্তীতে তার চাচা আল জাগলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে সাহায্য করেন। মুহাম্মদ ফারডিন্যান্ডের সাহায্যে তার পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গ্রানাডার অধিকারে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে ফারডিন্যান্ডের সেনাবাহিনী গ্রানাডার ভূমিতে পা ফেলতে সক্ষম হয়। ১৪৯০ সালে মুহাম্মদ যখন গ্রানাডা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন গ্রানাডা শহর ছাড়া আর কোনো অঞ্চলই তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলো না।

গ্রানাডা অধিকারের পরপরই, নতুন আমির মুহাম্মদকে রাজা ফারডিন্যান্ড গ্রানাডাকে তার হাতে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে মুহাম্মদ বিস্মিত হন এবং বুঝতে পারেন, তিনি এতোদিন ফারডিন্যান্ডের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন।

মুহাম্মদ খ্রিস্টান বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্বান্ত নেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। ছোট একটি ওসমানীয় নৌবহর ছাড়া আরো কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ১৪৯১ সালের শেষে গ্রানাডা ফারডিন্যান্ড ও ইসাবেলার সম্মিলিত বাহিনীর অবরোধের শিকার হয়। ১৪৯১ সালের নভেম্বরে মুহাম্মদ গ্রানাডার শাসন খ্রিস্টান অধিকারে প্রদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।

১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে স্পেনীয় সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম আন্দালুস রাষ্ট্রের পতন ঘটায়। খ্রিস্টান সৈন্যরা বিখ্যাত আলহামরা প্রাসাদ দখল করে এবং এর উপরে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তির বিজয়পতাকা উড়িয়ে দেয়। আলহামরার সর্বোচ্চ প্রাসাদে রূপার তৈরি একটি বিশাল ক্রুশ স্থাপিত হয়। আমির মুহাম্মদকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

চুক্তি অনুসারে যদিও খ্রিস্টান বাহিনী ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম নাগরিক অধিকারের প্রতিশ্রতি প্রদান করেছিলো, কিন্তু শীঘ্রই তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ১৫০২ ঈসায়ীতে সমগ্র স্পেনে ইসলামি বিশ্বাসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। অসংখ্য স্পেনীয় মুসলমান তখন উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করে। যারা স্পেনে ছিলো, তারাও তাদের বিশ্বাসকে গোপন করতে বাধ্য হয়। ১৬০০ ঈসায়ীর মধ্যে স্পেন সম্পূর্ণ রূপে মুসলিম শূন্য হয়ে পরে।

সূত্র : ফিরাস আল-খতীব-এর ‘মুসলিম স্পেনের সর্বশেষ দুর্গ’ অবলম্বনে নিহার মামদুহ

পূর্ববর্তি সংবাদখাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ প্রার্থীকে ভোট না দেয়ায় বাঙালি বাড়িতে আগুন
পরবর্তি সংবাদসাংবাদিক গ্রেফতারের বিষয়টি জানি না: ওবায়দুল কাদের