সায়্যিদ ওয়াযেহ রশীদ হাসানী নদভী : উজ্জ্বল স্মৃতির আঙিনা

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী ।।

জীবনের শেষ তাহাজ্জুদ। আল্লাহর কী লীলা—সেদিন দুইভাই একসাথেই ছিলেন সেই মেহমানখানা খ্যাত ভবনটিতে, যেখানে প্রিয় মামুজান সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী থাকতেন। আরব-আজমের বড় বড় মনীষীদের এখানে বসেই তিনি স্বাগত জানাতেন। তাঁদের সাথে কথা বলতেন। মতবিনিময় করতেন। হ্যাঁ, দুই ভাই এখানেই শুয়েছিলেন সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে।

রাত যখন একটু বাকি তাহাজ্জুদের সময় যখন শেষ হতে একটু বাকি, তখনই উঠে গেলেন ছোট ভাই মাওলানা সায়্যিদ ওয়াজেহ রশীদ হাসানী নদভী! প্রতিদিনের অভ্যেস—সহজে ছাড়া যায় না! ওযু করলেন! তারপর ধীরে পায়ে তাহাজ্জুদের মুসল্লায় দাঁড়ালেন! এক্ষুণি বলবেন—আল্লাহু আকবার! কিন্তু বলতে পারলেন না! প্রচণ্ড শাসকষ্ট শুরু হলো! এরপর? মাত্র পনেরো মিনিট! চলে গেলেন প্রিয় মাওলার সরাসরি সাক্ষাতে! ইলমে ওহীর বসন্তবিরাজিত কানন—দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার শেষ রাতের নীরব প্রহরে—খসে পড়লো আলোকোজ্জ্বল একটি নক্ষত্র! ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন!!

মূহূর্তেই নদওয়াতুল উলামা জেগে উঠলো! শেষরাতের মিষ্টি আবহে শোকের বাতাস বইতে লাগলো! প্রিয়বিরহে চোখে চোখে ঢল নামলো! ওই তো আযান হচ্ছে! আহ! আজ ফজরের আযানে কেনো বিরহগাথার এই তরঙ্গায়িত ঢেউ? কেনো এই নেই নেই সুর?! কেনো হোস্টেলগুলো থেকে ছুটে আসছে শীতের ভোরের কুয়াশা দলে শোকপ্লাবিত মিছিল?! আহ! সবার চোখে বাপহারা এতিমের অশ্রুকাতরতার অসহায় ছটফটানি! কেনো এমন এতিম করে হঠাৎ চলে গেলেন তিনি? রাতেই না হেসে হেসে কথা বলেছেন! তার আগে দরসে বসে ইলম আর প্রজ্ঞার দ্যুতি ছড়িয়েছেন! এশার পরেও তো তিনি কী স্বাভাবিক! কে জানতো—রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে এমন শোকপ্লাবিত ভোর?!

বড় হওয়ার সিঁড়িগুলো ছিল তাঁর বড় সুন্দর। জন্ম সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.-এর ভিটায়—রায়বেরেলিতে। ওখানেই প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর প্রিয় প্রতিষ্ঠান নদওয়ায়। প্রিয় মামুজান শায়খ আবুল হাসান আলী নদভীর তত্ত্বাবধানে, ছায়ায় বেড়ে উঠতে লাগলেন আগামী দিনের আরেক ‘আবুল হাসান’! সাধনায় অধ্যাবসায় কেটে যেতে লাগলো পাঠোধ্যয়নের সোনালি-রুপোলি বেলা। এক সময় ছোট্ট ওয়াজেহ হয়ে গেলেন সত্যিই ‘আবুল হাসান’! চিন্তা এক। ভাবনা এক। দৃষ্টি এক। দর্শন এক। দূরদৃষ্টি এক। প্রজ্ঞায় প্রজ্ঞায় ছাওয়া। অতীত-ঐতিহ্যের সোনা সোনা গৌরব-ভাবনায় দ্যুতিময়।

উর্দু তো ছিল তাঁর মাতৃভাষা। বলা যেমন, লেখাও তেমন। যেন পাখিডাকা ভোরে শিশিরায়িত সবুজ ঘাসে হেঁটে যাওয়া। আরবী? সে-ও আরেক মাতৃভাষা! শুধু বলতেই থাকা! শব্দের ভিড়ে বেছে বেছে শ্রেষ্ঠকে বেছে নেওয়া! কুরআন-হাদীসের মণি-মুক্তো তুলে তুলে আনা! ছাত্রদের সামনে যেন চলন্ত বিদ্যাপীঠ! যা বলতে চান তা-ই বলে যেতে পারেন অবিচ্ছিন্ন মুগ্ধতায় ছাত্র বা শ্রোতাকে জড়িয়ে রেখে! সহজ কণ্ঠে! সহজ ভঙিতে! সাবলীল ধারায়! এই গল্প ১৯৭৩ সালের পরের! এর আগে আলিগড়ে ইংরেজি নিয়ে ¯স্নাতক করেছেন। পরের ভাষাকে নিজের বানিয়েছেন। শাণিত হয়েছেন। ৫৩ থেকে ৭৩! এই ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন! আরবী ভাষার পরশে ধন্য করেছেন!

টানা বিশটি বছর অলইন্ডিয়া রেডিওতে ভাষ্যকার ও অনুবাদকের কাজ করেছেন। লেখা ও বলার সাংবাদিকতায় নতুন এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন! কিন্তু প্রিয় মামুজানকে লখনৌতে রেখে এই দূর দিল্লীতে কতোদিন আর থাকা যায়? বিশটা বছর কেটে গেছে এখানে কাজে কাজে! এবার আর মন টিকছে না! চলে গেলেন প্রিয় আবুল হাসান মামার কাছে! নোঙর ফেললেন সেখানেই! একেবারে ১৬ই জানুয়ারি ১৯ পর্যন্ত! আহ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!

তাঁর লেখা .. তাঁর বলার কথা কী বলবো! অনেক লিখেছেন। সমস্যা চিহ্নিত করে করে। রোগ ধরে ধরে। দিক নির্দেশ করে করে। আমার কাছে তাঁর লেখাকে মনে হয়—বিংশ শতাব্দির চ্যালেজ্ঞ মুকাবিলার সুসংহত শব্দচিত্র! তিনি একজন সুলেখক, সুসাহিত্যিক। তার নামের সাথে আরও কিছু অভিধা যুক্ত হবে। তিনি একজন প্রাজ্ঞ সাংবাদিকও। পাক্ষিক আর রায়েদ-এর সম্পাদক। মাসিক আল বাসুল ইসলামী-এর সহ সম্পাদক। সম্পাদনা মিশে ছিলো—তার চিন্তার সাথে, রক্তের সাথে।

বিশেষ করে, আধুনিক আরব সাংবাদিকতার সাথে তার গভীর সম্পক ছির্লো। যেকোনো আরব দেশের যে কোনো আরবি পত্রপত্রিকায় যেকোনো আধুনিক ও নতুন শব্দ প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি অনেক আরব সাংবাদিকের আগেই জেনে যেতেন। চোখ ভরে দেখেছি—অনেক আরবি পত্রপত্রিকা আসতো নদওয়াতে, বিশেষভাবে তার কাছে। ছোট্ট একটা ‘বগল-ব্যাগ’ থাকতো তার সাথে—সবসময়। এই ব্যাগে ভরা থাকতো অনেক নিত্যনতুন আরবি পত্রিকা। যখনই তাকে নদওয়াতে ঢুকতে দেখেছি অথবা বেরোতে দেখেছি, এই ব্যাগটিও সঙ্গে দেখেছি। এই ব্যাগ যেনো তার নিত্যসঙ্গী। এই ব্যাগ-এর উপকরণ যেনো তার নিত্যসহচর—বন্ধু।

এই ব্যাগের ওপর আমার চোখ পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো—নতুন নতুন আরবি পত্রিকার চাররঙা দৃষ্টিলোভা প্রচ্ছদ। খুব যতেœর সাথে—দরদ দিয়ে .. মায়া দিয়ে .. অবিরাম শ্রম ও অনিঃশেষ প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি সম্পাদনা করতেন পাক্ষিক আর রায়েদ পত্রিকাটি। প্রতি ১৫ দিন পর পর তা বের হওয়ার পর ভিড় জমে যেতো নদওয়ার ছাত্রদের ভেতরে—কার আগে কে সংগ্রহ করবে—এ নিয়ে। আমি নিজেও নিয়মিত সংগ্রহ করতাম। সুন্দর সুন্দর লেখার ভেতরে ডুবে যেতাম। হীরা-মণি-মুক্তা আহরণ করতাম। পরিশ্রমী পাঠক হয়ে—গভীর সমুদ্রের দক্ষ ডুবুরী হয়ে। আরব দেশের কতো পত্রিকা হাতে এসেছে, পড়েছি। কিন্তু আর রায়েদের মতো অন্য কোনো পত্রিকা আমাকে মুগ্ধ করতে পারে নি।

মনে পড়ে— আর রায়েদ পড়তে পড়তে একবার ভাবলাম— একটি লেখা দেবো। যদি ছাপা হয়! লেখাটি খুব মেহনত করে তৈরি করলাম। জমাও দিলাম। মনে দুরুদুরু ভাবনা। হয়তো আসবে না! কিন্তু আমাকে অবাক-মুগ্ধ করে দিয়ে লেখাটি এসেছিলো! হযরত মাওলানা ওয়াজেহ সাহেব আমার লেখাটির গায়ে তার কোমল সম্পাদনার পরশ বুলিয়েছেন। গুরুত্বহীন ও অমানসম্পন্ন একটি লেখা তার সুদক্ষ সম্পাদনায় আল রায়েদে ছাপার উপযুক্ততা লাভ করেছিলো। আমি কতোবার যে মুগ্ধতা ও উল্লাসভরে সেই লেখাটা পড়েছি—হিসাব নেই। সংখ্যা ও শিরোনাম এখন মনে নেই। সংখ্যাটি সংরক্ষণও করে রাখতে পারি নি। এই ঘটনা ছিলো আমার নদওয়া জীবনের বিকেল বেলায়। আফসোস! কেনো আমি প্রথম বছর থেকেই আর রায়েদে নিয়মিত লেখা দেওয়ার কথা ভাবি নি—সেজন্য সাধনা করি নি?

খুব শখ ছিলো—মাওলানা ওয়াজেহ সাহেবের কাছে পড়বো। কিন্তু দুই বছরের এক বছরেও তার কাছে আমাদের কোনো ঘণ্টা পড়লো না। সান্ত¡না শুধু এতোটুকুই যে, আমার লেখায় তার পরশ লেগেছে। আমি তার কাছে একটু হলেও শিখেছি— কীভাবে আরবি লিখতে হয়! কীভাবে সসীম গণ্ডি থেকে একটি লেখা অসীম গণ্ডিতে নিয়ে যেতে হয়? কীভাবে অযত্নে ছাওয়া ফুলকলিকে পুষ্পময়তায় বিকশিত করতে হয়! এ-ই বা কম কী? বড়দের সান্নিধ্যের দ্যুতির একটুখানি ঝলকানি ছোটদের সামনে খুলে দেয়—সম্ভাবনার অবারিত দিগন্ত।

প্রিয় মাওলানা, নদওয়া ছেড়ে আসার পর আপনার সাথে আমার আরও দেখা হয়েছে। তখনো আপনি মহান! মায়াদিল! বড় একটি লেখা দেখে দিয়েছেন খুব যত্ন করে। আপনার কাছ থেকে আমি উপকৃত হয়েছি আরো নানাভাবে। আপনার মুক্তাখচিত লেখা পড়ে পড়ে। কিতাব পড়ে পড়ে। কী সুন্দর সুন্দর বিষয় নিয়ে কী দারুণ দারুণ কিতাব লিখেছেন আপনি। কিতাবের নামগুলো কী যে মিষ্টি লাগে— ইসলামী জাগরণী সাহিত্য, হৃদয়বানদের সাহিত্য, আধুনিক যুগের আরবি সাহিত্যের মহারথীরা, নতুন বিশ্বব্যবস্থার খোঁজে, সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ., ইসলামী সংস্কৃতির ইতিহাস, হিন্দুস্তানে ইসলামী শিক্ষা সিলেবাস পরিক্রমা, পয়গামে ইনসানিয়াত: সাম্প্রদায়িকতা ও কট্টরপন্থা মুকাবিলায় তার ভূমিকা, হিন্দুস্তানে ইসলামের দাওয়াত ও তার পন্থা, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী: একজন প্রাজ্ঞ দিশারী, সিরাতের একটুখানি ঝলক .. সিরাত সাহিত্যের একটু দ্যুতি, নবী আমার এমন ছিলেন (এক ঝলকে)শায়খ নদভীর রচনাবলীতে সাহিত্যের পশলা পশলা বৃষ্টি, আরবি সাহিত্যের উৎসধারা।

প্রিয় মাওলানা, এই যে আপনার বাগান থেকে ফুল কুড়িয়ে কুড়িয়ে কেমন সুন্দর গেঁথে ফেলেছি আমি—একটি মালা! প্রিয় মাওলানা, আমি একটি স্মৃতিকথা লিখছি! সেখানে আপনার কথা বলেছি! আপনি জীবিত! আর এখন? গতকালই জানতে পারলাম— আপনি আর নেই! কীভাবে সইবো এ শোক?

পূর্ববর্তি সংবাদ১৯ ভোটে টিকে গেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে
পরবর্তি সংবাদসংসদ সদস্যদের শপথ বাতিলের রিট আবেদন খারিজ