সাউথ এশিয়ান মনিটরের পর্যবেক্ষণ: শ্রীলংকায় সহিংসতার দিকে মুসলিমদের ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা!

সাউথ এশিয়া মনিটর সম্প্রতি তাদের কলম্বো প্রতিনিধির বরাতে শ্রীলংকার মুসলিমদের প্রতি চালানো নানা অবিচারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেটি পাঠকদের জন্য এখানে দেয়া হলো।

গত সপ্তাহে শ্রীলংকার প্রতিরক্ষা সচিব হেমাসিরি ফার্নান্দোর একটি বিতর্কিত মন্তব্যে চোখ কপালে তুলেছেন অনেকেই। তিনি বলেন, যারা পদক পেয়েছেন তারাই শুধু যুদ্ধবীর, সামরিক বাহিনীর আর কেউ নয়। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে ‘হাই-প্রফাইল মার্ডার কেসে’ ১১ সেনার বিচার করা হবে। সেনাসদস্যদের অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য দিতে জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সচিব আরো বলেন, কোন সেনাসদস্য যদি অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই আহ্বান দেশের তামিল জনগোষ্ঠীরই দাবি। ৩০ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের পর থেকেই তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলো আমলে নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।

কলম্বোর এক অনুষ্ঠানে ওই বক্তব্য দেয়ার সময় প্রতিরক্ষা সচিব ঘোষণা দেন যে কোন সামরিক সদস্য আইনের উর্ধ্বে নয়।

তিনি বলেন, যেদিন কোন যুদ্ধবীর গিয়ে কাউকে খুন করবে সে আর যুদ্ধবীর থাকবে না। তখন থেকে তার পরিচয় একজন খুনি। তাকে শ্রীলংকার আইনের সামনে হাজির করতে হবে এবং আদালতের মাধ্যমে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।

সচিব আরো বলেন, দেশে মাত্র ৩৯,০০০ যুদ্ধবীর রয়েছেন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৩৪,০০০, নৌবাহিনীর ৪,৪০০ ও বিমানবাহিনীর ৮৬৮ জন। কাউকে যুদ্ধবীর বলতে হলে তার যুদ্ধবীরের পদক এবং গেজেটে নাম থাকতে হবে।

সচিবের মন্তব্যকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বাগত জানালেও সংখ্যাগুরু সিনহলি জনগোষ্ঠী মনে করে এটা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। ২০০৯ সালে শেষ হওয়া যুদ্ধের শেষ দিকে সেনাবাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে অভিযোগে পশ্চিমা দেশগুলো বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে। অনেকেই ফার্নান্দোর মন্তব্যকে কমবেশি তামিল জনগোষ্ঠীর দাবি বলেই মনে করছেন এবং এর বহুমুখি প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই মন্তব্য ৩০ বছর ধরে যুদ্ধ করা সেনাবাহিনীকে অসন্তুষ্ট করতে পারে এবং জাতিগত অশান্তি যেমন মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা উষ্কে দিতে পারে। এই এক বছর আগেও, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে এমন দাঙ্গা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এই মুহূর্তে যখন পুলিশকে প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়েছে এবং পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা মাত্র এক ব্যক্তি হেমাসিরি ফার্নান্দোর দায়িত্বে রয়েছে তখন তার মন্তব্যটি গুরুতর রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ক্যান্ডিতে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা’র এক বছরের মাথায় এই মন্তব্য করলেন প্রতিরক্ষা সচিব। ক্যান্ডির দাঙ্গা থামিয়েছিলো সেনাবাহিনী। এমন এক সময় এই মন্তব্য করা হলো যখন ক্যান্ডি জেলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মাওয়ানেল্লা ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের পুত্তালামে সহিংসতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুত্তালাম জেলা থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধমূর্তি ভাংচুরের অভিযোগে মাওয়ানেল্লা এলাকার কয়েকজন মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা নাকি বলেছে শান্তিকামী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকজন চরমপন্থী মুসলিম প্রচারক তাদেরকে এ কাজ করতে বলেছে। মাওয়ানেল্লা এলাকা থেকে ১১টি মুসলিম পরিবার বিভিন্ন মুসলিম দেশে চলে গেছে।

কিন্তু শ্রীলংকায় মুসলমানরা সহিংসতা সৃষ্টি করেছে এমন ঘটনা বিরল। শ্রীলংকার দুই কোটি জনসংখ্যার ১০% মুসলমান এবং তারা সহিংস পন্থায় আলাদা রাজ্য গঠনের মতো তামিলদের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত হয়নি। এরই প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের কোন গ্রুপ যদি সহিংসতা চালানোর পরিকল্পনা করে থাকে তাহলে বুদু বালা সেনা (বিবিএস)’র মতো চরমপন্থী সিনহলী গ্রুপগুলো সেটা কিভাবে ব্যবহার করবে তা নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে।

বিবিএস’র সাধারণ সম্পাদক জিনানসেরা থেরোর প্রতি প্রেসিডেন্টের ক্ষমা ঘোষণার পরিকল্পনা নিয়ে উদার শ্রীলংকানরা উদ্বিগ্ন। আদালত অবমাননার দায়ে তিনি এখন জেলে। ধারণা করা হচ্ছে ৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা দিবসে প্রেসিডেন্টের বিশেষ ক্ষমায় থেরো মুক্তি পেতে পারেন।

শ্রীলংকা যখন স্বাধীনতার ৭১ বছর উযযাপন করতে যাচ্ছে তখন একজন চরমপন্থী সন্যাসীর বিশেষ ক্ষমায় মুক্তি, গুটিকতক মুসলমানকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কে প্রতিরক্ষা সচিবের কঠোর মন্তব্য দেশটিকে আবারে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। অথচ স্থিতিশীলতার জন্য দেশটি এখনো সংগ্রাম করছে।

দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশটিকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতার ভাগ দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত সাংবিধানিক সংস্কার হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় সেখানেও আলাদাভাবে অশান্তি দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি মুসলিমদের মনে এখনো গত বছরের ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার ছবি স্পষ্ট। এরপরও যদি একজন বিপজ্জনক চরমপন্থী সন্যাসীকে মুক্ত নাগরিকের মতো ঘুরে বেরাতে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে তা হবে মানসিক সুস্থতার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো।

পূর্ববর্তি সংবাদতীব্র শীতে কাবু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চল, ১২ জনের মৃত্যু
পরবর্তি সংবাদআজ বিশ্বব্যাপী ‘হিজাব দিবস’ পালিত