বাংলা নিষিদ্ধের যুগে আমরা অবাধে বাংলা পড়েছি : ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী। সময়ের ইসলামি ধারার অন্যতম সেরা লেখক। যিনি লিখছেন প্রায় তিন দশক ধরে। লিখেছেন ইসলামি সাহিত্যের নানা বিষয়ে। তবে তিনি প্রধানত একজন শিশু সাহিত্যিক ও সিরাত লেখক। তার লেখায় সিরাত ও শিশু সাহিত্যের সন্নিবেশ ইসলামি সাহিত্যচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সাথে সাথে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাক্যশৈলীও।

বাংলা সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি আরবির প্রতিও রয়েছে তার গভীর মনোযোগ ও মমত্ববোধ। তাই চেষ্টা করছেন আরবি ও বাংলা ভাষার মধ্যে একটি কল্যাণের সেতুবন্ধন তৈরি করতে।

১৯৬৮ সালে কিশোরগঞ্জে জন্ম নেয়া এই মধ্য বয়সী লেখকের মুদ্রিত বইয়ের সংখ্যা ২০টি। প্রকাশের পথে রয়েছে আরও ৪টি বই। কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় পড়ার সময় আল আশরাফ দেয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় আজকের ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর। তার লেখা প্রথম বই ‘আলোর দিগন্ত হজরত ওমর রা.’ এবং প্রকাশিত প্রথম বই ‘তোমার স্মরণে হে রাসুল’ ।  এখন কাজ করছেন ‘দাদু একটি গল্প বল’ শিশু সিরিজের।

তার সাহিত্য চর্চা, সিরাত ও আরবি ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ইসলাম টাইমসের সঙ্গে। একান্ত কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আতাউর রহমান খসরু


 

ইসলাম টাইমস : লেখালেখির শুরু থেকে আজ যে আপনি একটি নিজস্ব লিখনশৈলী গড়ে তুলেছেন –এই পথপরিক্রমা সম্পর্কে যদি একটু বলতেন?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : ছোট থেকে লেখালেখির প্রতি একটা আগ্রহ ছিলো, হৃদয়ের টান ছিলো। আমরা যখন কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় পড়তাম, তখন হজরত মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ ও হজরত মাওলানা ইসমাইল বরিশালী সেখানে ছিলেন। তাদের দেখে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কামরাঙ্গীরচর মাদরাসা থেকে একটি দেয়াল পত্রিকা বের হতো আল-আশরাফ নামে। সেখানে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ, মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহ.সহ অনেকেই লিখতাম। সেটাই আমাদের সূচনা।

আমরা সেই পরিবেশে থাকার কারণে নানানভাবে উপকৃত হয়েছি। আমরা সেখানে বইয়ের একটি চমৎকার ঠিকানা পেয়েছিলাম। হজরত মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ-এর পাঠাগারে আমাদের যাতায়াত ছিলো। আমরা সেখান থেকে চমৎকার চমৎকার বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি।

আরও পড়ুন : শির দেগা—নেহি দেগা আমামা

একবার হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমি একটি বাংলা বই পড়বো। আমাদের নিয়ম ছিলো আমরা আদিব হুজুরের অনুমতি ছাড়া কিছুই পড়তাম না। আমি হুজুরকে বললাম, আমি একটা বাংলা বই পড়তে চাচ্ছি। হুজুর নিজের পাঠাগার থেকে আমাকে শিশু সাহিত্যের উপর দারুণ একটি বই এনে দিলেন। বইটার নাম মামার বিয়ের বরযাত্রী। লেখক খান মোহাম্মদ ফারাবী।

বলা যায় বাংলা নিষিদ্ধ থাকার যুগে আমরা অবাধে বাংলা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। সেটা পেয়েছি হুজুরের সান্নিধ্যে ও তার পরশে থাকার কারণে। এসব সুযোগ ও পাঠ আমাদের লেখালেখির আগ্রহকে শাণিত করেছে, অনেকটা ঋদ্ধ হয়েছে। আমাদের লেখাতে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করেছে।

ইসলাম টাইমস : আমরা জানি, আরবির সঙ্গেও আপনার যোগাযোগ গভীর। আরবি সাহিত্যের কোন দিকটা আপনাকে মুগ্ধ করেছে?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : ভারত-পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম সাহিত্য চর্চায় আমাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। আর আরব বিশ্বের উলামায়ে কেরাম শিশু সাহিত্যে তাদের চেয়েও এগিয়ে। কুরআনের ভাষা, হাদিসের ভাষা ও ধর্মীয় ভাষা এসব বিবেচনা বাদ দিয়ে যদি শুধু সাহিত্যের বিচার করি, তবুও আরবি ভাষা বিশেষ মর্যাদার দাবিদার। বিশেষত আরবি ভাষায় শিশু সাহিত্যের যে সম্পদ গড়ে উঠেছে তা পৃথিবীর আর কোথাও গড়ে ওঠেনি। এজন্য আরবি ভাষা আমাদের অবশ্যই চর্চা করা উচিৎ। বিশেষত যারা লেখালেখিতে থাকতে চান, শিশু সাহিত্য চর্চা করতে চান।

ইসলাম টাইমস : আরবি সাহিত্যের সাথে আপনার পরিচয় ও যোগযোগ হয় কীভাবে?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : উনিশশো আশির দশক থেকে। যখন আমরা এসো আরবী শিখি পড়েছি তখন থেকে আরবীর প্রতি টান তৈরি হয়েছে। আমরা আদিব হুজুরের কাছে মাত্র ৩ মাসে এসো আরবী শিখি পড়েছি। এরপর ওই বছরই আমরা কাসাসুন নাবিয়্যিন, শিশুদের পত্রিকা ইক্বরাসহ আরবি পত্র-পত্রিকা পড়ে ফেলেছিলাম। হুজুর আমাদের ভেতর আরবি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেন। তিনি বলতেন সব সময় আরবি চর্চা করবে। রুটিন করে শিখতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আরও আরবি বই পড়তে হবে। বই পড়ার পর তার একটি খুলাসাও (সারকথা) তৈরি করতে হবে। আমরা একাধিক বইয়ের খুলাসা তৈরি করে হুজুরকে দেখিয়েছি।

ইসলাম টাইমস : আরবি ভাষার কোন বই থেকে আপনি বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : যদি কোনো সিরিজের কথা বলি তাহলে আল হাদিকাতুল খদরা’-এর কথা বলবো। এই সিরিজের বেশ কয়েকটি বই আমি পড়েছি। শায়খ নদভির কাসাসুন নাবিয়্যিন, আল ক্বেরাআতুর রাশেদাহ আমাদেরকে অনেক বেশি উপকৃত করেছে। বড় হয়ে আরব বিশ্বের অনেক লেখকের লেখা পড়েছি। কিন্তু সেই সময়ে শায়খ নদভির কাসাসুন নাবিয়্যিন আমাদেরকে অনেক উপকৃত করেছে, সেটাই ছিলো আমাদের মূল চেতনা। এছাড়াও আদিব হুজুরের আহাদ .. আহাদ, হায়াতুর রাসুল, ফাউকাস সালীব, ওয়াজা আ আবু বাকরিন আমাকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছে।

ইসলাম টাইমস : এই সময়ে আরবি ভাষার বিশুদ্ধ চিন্তার শিশু সাহিত্যিক কে? যাকে তরুণরা পড়তে পারেন?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : নদওয়াতুল উলামায় থাকতে আমি একই প্রশ্ন আমার শিক্ষককে করেছিলাম। তিনি আমাকে কামেল কিলানির ‘আল-কাসাসুল আরাবিয়্যাহ’-এর কথা বলেন। তার ভাষায় এটা সবচেয়ে উপযোগী, সুন্দর ও গেলার মতো আরবি সাহিত্য। এটা রূপকথা হলেও এর ভঙ্গি ও শৈলী খুব সুন্দর ও শিক্ষামূলক। তার আরবি পাঠককে সামনে টেনে নিয়ে যায়। এগুলো পড়লে নিজের অজান্তে একটা যোগ্যতা গড়ে ওঠে।

ইসলাম টাইমস : আপনার এ যাবতকালের কাজের মধ্যে কোনটাকে আপনার বেশি ভালো লাগে এবং কেনো?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : আমি খুব বেশি কাজ করেছি এমনও না। আমার করা কাজগুলোর মধ্যে সিরাতের ওপর লেখা ‘প্রিয় নবী’ বইটার উপর আমার আলাদা একটা মায়া আছে। ভালোবাসা আছে। অনেক পরিশ্রম ও সময় দিয়ে লিখেছি বইটা। এটার পেছনে অনেক স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। বইটা লেখা সময় আমি শিশুদের আবেগ অনুভূতিকে সামনে রাখার চেষ্টা করেছি। একজন শিশু যখন আল্লাহর রাসুল সা.-এর জীবনী পড়বে সে যেনো মক্কা ও মদিনার পরিবেশের মধ্যে আছে এমন মনে করে। আল হামদুলিল্লাহ! পাঠকের সাড়াও তেমন পেয়েছি।

ইসলাম টাইমস : সিরাতের প্রতি আপনার একটি আকর্ষণবোধ পাঠক অনুভব করে। সেটা কীভাবে গড়ে উঠলো?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : আমার মনে হয়, আমাদের জীবনে –যারা নবীর উত্তরসূরী- সিরাত ছাড়া কোনো স্বপ্ন, বাসনা ও অভিলাষ কল্পনা করা যায় না। আমরা যখন বই পড়তে শুরু করেছি, তখন আমরা সিরাতের চমৎকার চমৎকার বই হাতে পেয়েছি। সে সময়ে আমি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী পড়েছি, বিষাদ সিন্ধু পড়েছি -যা পাঠ করে সিরাতের প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। সিরাত পাঠই আমাদেরকে সিরাতের প্রতি আগ্রহী করেছে। আমি যখন হিফজখানায় পড়ি তখনই আমি সিরাতের উপর লিখতে চেষ্টা করতাম।

আরও পড়ুন : সায়্যিদ ওয়াযেহ রশীদ হাসানী নদভী : উজ্জ্বল স্মৃতির আঙিনা

আপনাদের মাধ্যমে আমি বলবো, সিরাত যেন সব শিশু-কিশোরের অবিচ্ছেদ্য পাঠ্য হয়। বিশেষত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে শিশু সাহিত্যের উপর বাংলা ও আরবি ভাষায় রচিত সিরাত গ্রন্থগুলো তুলে দেওয়া প্রয়োজন। এবং আমাদের পরিকল্পনার অংশ হওয়া প্রয়োজন।

সিরাতের উপর আমার ৩টি বই রয়েছে। তাহলো, গল্গে আঁকা সিরাত, প্রিয় নবী, তোমার স্মরণে হে রাসুল!। এছাড়াও আশারায়ে মোবাশশারা, মহীয়সী খাদিজা, নবীজীর ঘরোয়া জীবন-এর কাজ চলছে। সিরাত আমাকে অবিরাম টানছে।

ইসলাম টাইমস : আপনাকে যদি বলা হয়, আরবি ভাষার কয়েকজন লেখকের সঙ্গে তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিন। আপনি কাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন?

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : আমি প্রথমে দুইজন আরব লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। একজনের কথা আগেই বলেছি, কামেল কিলানি। কামেল কিলানি পড়তে পড়তে যারা পরিণত হবে তাদেরকে আলি তানতাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। তবে তাকে শুরু করতে হবে হিকায়াতুম মিনাত তারিখ –গল্পে আঁকা ইতিহাস যার অনুবাদ। এরপর কিসসাতু হায়াতি ওমর। পাশাপাশি সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবাহ, সুয়ারু মিন হায়াতিত তাবিঈন-এর লেখক ড. আবদুর রহমান রা’ফাত পাশার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। এসব লেখকের লেখা তরুণদের মনে আরবির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করবে বলে আমার ধারণা।

পূর্ববর্তি সংবাদআল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে তুর্কি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
পরবর্তি সংবাদকৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে না : ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন