ভাষা আন্দোলনের অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ.

সাঈদ হোসাইন ।।

খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এ দেশের খ্যাতনামা একজন আলিম, মুহাদ্দিস, বক্তা, রাজনীতিক ও জাতীয় সংসদ সদস্য। বাংলাদেশে ও ভারতে উর্দূ ও আরবি মাধ্যমে লেখাপড়া করলেও নিজ মাতৃভাষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অকৃত্রিম।তিনি সারা জীবন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ওয়ায, নসিহত ও তাফসির করেছেন বাংলা ভাষায়।

১৯৫৪ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান পারলামেন্টে উর্দূ, ইংরেজি ও বাংলা এ ৩ ভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকলেও তিনি সব সময় বাংলায় বক্তব্য রাখেন এবং বিতর্কে অংশ নেন। বাংলা ভাষায় বেশ কিছু গ্রন্থও রচনা করেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মাদরাসা শিক্ষার ক্রমবিকাশের ধারা, আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য, খাতমুল মুরসালিন, মাওয়ায়েজে খতিবে আযম ২খণ্ড, শানে নুবুওয়াত ৮খণ্ড, খতমে নুবুওয়াত , মেরাজুন্নবী সা., শিক্ষা কমিশনের প্রশ্নমালার উত্তর, সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, বাংলায় মুসলিম সমাজের ক্রমবিকাশধারা, ইত্যাদি। (তথ্যসূত্র: খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ জীবন ও কর্মসাধনা- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রকাশক: মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, দ্বিতীয় সংস্করণ: জুন ২০১৪)

তিনি কেবল মাদরাসা পাস একজন আলেম হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্যের প্রতি ছিলেন বিশেষ অনুরাগী। বাংলা ভাষাভাষী জনগণ বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষিতদের মাঝে লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহের অমীয় বাণী তুলে ধরার নিমিত্ত বাংলা ও ইংরেজি ভাষা তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং মুসলিম যুব সমাজকে বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্যের প্রতি উৎসাহিত করতেন। (সূত্র: ইসলাম ও মাতৃভাষা, মুফতি আব্দুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী, দারুল হুদা কুতুবখানা, প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০১২, পৃ. ১৫৮)

তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পাক আমলে ‘দৈনিক নাজাত, সাপ্তাহিক ‘নেজামে ইসলাম’ আল-হেলাল, জিন্দেগী, সওতুল ইসলাম প্রভৃতি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এমনিভাবে তিনি তৎকালীন সাহিত্য-সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আঞ্জুমান তাহাফফুজে ইসলাম নামক একটি ইসলামী গবেষণা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উক্ত একাডেমির মাধ্যমে কুরআন ও হাদিস সম্বলিত বহু জ্ঞানগর্ভ বই-পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের স্বরূপ উন্মোচন করে জাতিকে সতর্ক করেছিলেন, যার জুড়ি আজও মিলেনি। এমনিভাবে জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মুফতি আজিজুল হক মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্য চর্চার নিমিত্ত যে ইসলামী গবেষণা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন এ একাডেমির পরিচালক। (সূত্র: ইসলাম ও মাতৃভাষা, মুফতি আব্দুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী, দারুল হুদা কুতুবখানা, প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০১২, পৃ. ২৪৪)

কওমি মাদরাসাসমূহ যেন মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব দেয় সেজন্য আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস (কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড)-এর এক ইশতেহারে তিনি বলেন, দরসে নেজামীতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষা দেয়ার গুরুত্ব নেই। এ কারণেই আমাদের কওমি মাদরাসাসমূহের ফারিগ (গ্র্যাজুয়েট) ছাত্ররা বিশুদ্ধ বাংলা না বলতে পারে আর না লিখতে পারে। অথচ আমাদের শ্রোতা বা পাঠকগণের অধিকাংশ বাংলাই বুঝে। এর ফলে ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য তাবলীগ ও দাওয়াতের পরিধি অধিক থেকে অধিক সংকোচিত হয়ে পড়ছে। (সূত্র: আমার জীবনকথা, আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী, নদভী প্রকাশনী, প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৪, পৃষ্ঠা ১৮৪)

বাংলা চর্চা, কথ্য ও লিখিত আরবি ভাষার উৎকর্ষের মাধ্যমে মাদরাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ও যোগ্য নাগরিক হিসেবেগড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগচাহিদার প্রতি সঙ্গতি রেখে খতিবে আযম একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করেন। (তথ্যসূত্র: খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ জীবন ও কর্মসাধনা- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রকাশক: মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, দ্বিতীয় সংস্করণ: জুন ২০১৪, পৃ. ২৪)

যখন পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মাতৃভাষাকে চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে গড়িমসি শুরু করল, তখন তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেনন।

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রফেসর জনাব সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, জনাব আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া, মৌলভী ফরিদ আহমদ, মাওলানা ছিদ্দিক আহমদসহ গুরুত্বপূর্ণ আলমদের নেতৃত্বে গঠিত ‘নেজামে ইসলাম পার্টি’ ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করে। (তথ্যসূত্র: মুকুল চৌধুরী সম্পাদিত, অগ্রপথিক সংকলন ভাষা আন্দোলন, প্রকাশনায়: ঢাকা ই.ফা.বা., প্রকাশকাল: ১৯৯৩,পৃষ্ঠা ১৩৩; ইসলাম ও মাতৃভাষা, মুফতি আব্দুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী, দারুল হুদা কুতুবখানা, প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০১২, পৃ. ১৫৮-১৫৯)

১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ তারিখে কিশোরগঞ্জের হযরতনগরে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলন। এতে সর্ব মহলের বিশিষ্ট আলেমগণ অংশগ্রহণ করেন। এ ঐতিহাসিক সম্মেলনের প্রথম দিন জমিয়তের কাউন্সিল মাওলানা আতহার আলী রহ. এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবই ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা প্রসঙ্গে। প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ:

চতুর্থ প্রস্তাব: খ.পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের এই সম্মেলন পাকিস্তান গণপরিষদের নিকট দৃঢ়তার সহিত দাবি জানাইতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা রুপে গ্রহণ করা হোক। (তথ্যসূত্র: হায়াতে আতহার (বাংলা), মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী, প্রকাশক: আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার প্রকাশনা বিভাগের পক্ষে (মাও) আনোয়ার শাহ প্রকাশকাল: ৩ মে ২০০৪; পৃ. ১৩৮)

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে শুধুমাত্র প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত ছিল না তাঁর দল; বরং দলের সংবিধানেও এই দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছে। এটা শুধু দাবি হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দলের আদর্শগত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এমনকি এটা শুধু পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সংবিধানেই নয়, বরং সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজধানী করাচীতে পশ্চিম পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আদর্শগত ঘোষণা ছিল। (তথ্যসূত্র: প্রাগুক্ত)

ভাষা আন্দোলনে খতিবে আযম রহ. এবং তাঁর দল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি যে শ্রম, মেধা ও সাহসিকতার সঙ্গে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় গৌরবোজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচনে বিএনপি হারেনি, হেরেছে গণতন্ত্র: বিএনপি
পরবর্তি সংবাদআমরা কাশ্মীর বিষয়ে একচুল পরিমাণও ছাড় দিতে রাজি নই: আলভি