উলামা বিদ্বেষ দিয়ে শুরু হয় কাদিয়ানিদের দাওয়াত : মাওলানা আবু সালমান

মাওলানা আবু সালমান। ঢাকার বিশিষ্ট দাঈ ও কাদিয়ানি বিশেষজ্ঞ আলেম। বেশ কিছুদিন যাবত তিনি দেশের কাদিয়ানি ফেতনা নিয়ে কাজ করছেন। কাদিয়ানি ফেতনার স্বরূপ দেখতে এবং মানুষকে ঈমানের পথে ফিরিয়ে আনতে তিনি সফর করেছেন দেশের কাদিয়ানি প্রভাবিত অঞ্চলগুলোতে। কাদিয়ানি মতবাদের ওপর তার লেখাপড়ার পরিধিও বেশ বিস্তৃত।

সম্প্রতি পঞ্চগড়ে কাদিয়ানিদের কথিত ইজতেমা ইস্যুতে সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তার সঙ্গে দেশে বাংলাদেশে কাদিয়ানি তৎপরতা এবং এ বিষয়ে মুসলমানদের করণীয় নিয়ে ইসলাম টাইমসের পক্ষ থেকে কথা বলেন আতাউর রহমান খসরু।


ইসলাম টাইমস : বর্তমানে পঞ্চগড়ের কাদিয়ানি ইজতেমা নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন ও বিক্ষোভ হচ্ছে। পঞ্চগড়ের এই ইজতেমার বিশেষ কোনো গুরুত্ব আছে কী?

মাওলানা আবু সালমান : হ্যা, কিছুটা গুরুত্ব তো অবশ্যই আছে। কাদিয়ানিরা ব্যাপক আয়োজনে এই ইজতেমা করছে –যা কিছুতেই শুভ লক্ষণ নয়। বলা যায়, তারা তাদের শক্তির একটা মহড়া দিতে চাচ্ছে।
তাছাড়া পঞ্চগড়ের আহমদনগর দেশের একটি প্রাচীনতম কাদিয়ানি কেন্দ্র। কাদিয়ানিরা এই কেন্দ্রকে বলে দারুল হিজরা বা আশ্রয়স্থল। সারা দেশের কোনো কাদিয়ানি এলাকা ছাড়া হলে তাকে আহমদনগরে পুনঃবাসন করা হয়। সুতরাং কাদিয়ানি ইজতেমা ছাড়াও আহমদনগরের কার্যক্রম নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ইসলাম টাইমস : বর্তমানে বাংলাদেশে কাদিয়ানি তৎপরতা কোন পর্যায়ে রয়েছে?
মাওলানা আবু সালমান : গত ৪-৫ বছর কাদিয়ানি বিষয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে কাদিয়ানি তৎপরতা অনেক বেড়েছে। বিশেষত গত ১০ বছরে তারা নতুন করে দেশের বিভিন্ন জেলায় কার্যক্রম শুরু করেছে এবং নতুন নতুন ইবাদতখানা গড়ে তুলেছে। বহু মানুষকে তারা ঈমানহারা করেছে এই দশ বছরে।

ইসলাম টাইমস : বর্তমানে তারা কোন কৌশলে কাজ করছে?
মাওলানা আবু সালমান : গত ১০ বছরের কাদিয়ানি তৎপরতা আগের তুলনায় একটু ভিন্ন। এখন তারা অনেক বেশি সচেতন। তারা তাদের সব ধরনের কার্যক্রম অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন করছে। একটা সময় তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়ে যেতো এবং এতে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলন করতো। কিন্তু এখন তারা অনেক সতর্ক। যেন মুসলমানরা কোনোভাবে ক্ষিপ্ত না হয় এবং তারা গোপনে কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
আপনি দেখবেন, গত দশ বছরে কাদিয়ানি ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলনও হয়নি।

ইসলাম টাইমস : দেশের কোন কোন জেলায় কাদিয়ানি তৎপরতা সবচেয়ে বেশি?
মাওলানা আবু সালমান : উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নিলফামারী,নাটোর,রংপুর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের পঞ্চগড়ঘেষা অংশ। এছাড়াও শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোণায় তাদের কার্যক্রম অনেক বেশি। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরায়ও কাদিয়ানি তৎপরতা অনেক বেশি।

পঞ্চগড়ের আহমদনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে প্রায় এক হাজার কাদিয়ানি পরিবার রয়েছে। সাতক্ষীরায় কাদিয়ানি ভোটার রয়েছে এক হাজার। তাহলে এসব এলাকায় কাদিয়ানিদের সংখ্যা কতো হতে পারে ধারণা করুন।

ইসলাম টাইমস : কাদিয়ানিরা এখন কোন কৌশলে কাজ করছে বলে আপনার মনে হয়?
মাওলানা আবু সালমান : তারা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কৌশলে কাজ করে। যেমন, এক জায়গায় একটি কাদিয়ানি পরিবার রয়েছে। তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুসলিম আত্মীয় রয়েছে। তখন এই কাদিয়ানি পরিবার তার একটি আত্মীয় পরিবার টার্গেট করে কাদিয়ানি মুয়াল্লিমদের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয়। তাকে কাদিয়ানিদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে। সেখানে ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করে। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে।

ইসলাম টাইমস : এমন কি হচ্ছে যে, ইসলাম ও কাদিয়ানি মতবাদের পার্থক্য না বুঝে কেউ কাদিয়ানি হয়ে যাচ্ছে?
মাওলানা আবু সালমান : যারা কাদিয়ানি হচ্ছে তাদের বড় অংশই বুঝতে পারে না যে, তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। বরং তারা মনে করে, ভুল ইসলাম ছেড়ে তারা সঠিক ইসলাম গ্রহণ করছে। এমন দেখেছি, দীর্ঘদিন কাদিয়ানি থাকারও পর তারা জানে না যে তারা আর মুসলমান নেই। তাদের একটি বইও আছে ‘আহমদিয়্যাত ইয়া’নি হাকিকি ইসলাম’ –যাতে বলা হয়েছে, আহমদিয়ারাই প্রকৃত মুসলিম আর অন্যরা কাফির। তাদেরকে বোঝানো হয়, রাসুল সা. যে মাহদির কথা বলেছিলেন, গোলাম আহমদ কাদিয়ানিই সেই প্রতিশ্রুত মাহদি।

ইসলাম টাইমস : কাদিয়ানিদের দ্বারা সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে?

মাওলানা আবু সালমান: কাদিয়ানিরা কাজ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয় সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। যেন সে কাদিয়ানি হলে তার প্রভাবে আরও কিছু মানুষ কাদিয়ানি হয়ে যায়। তা না হলে অন্তত তার ছত্রছায়ায় ‘দাওয়াতি’ কাজ পরিচালনা করা যায়।
এরপর তাদের টার্গেট থাকে গ্রামের শিক্ষিত যুবক যারা লেখাপড়া করছে। তাদেরকে ওরা সরাসরি দাওয়াত দেয় না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। লেখাপড়ার খরচ দেয়। শিক্ষা উপকরণ দেয়। উন্নত জীবন গঠনের পরামর্শ দেয় এবং স্বপ্ন দেখায়। তবে শিক্ষিত মানুষের ভেতর ওরা খুব বেশি সফল , তা বলা যাবে না। শিক্ষিত শ্রেণির ভেতর যারা নিজেদেরকে স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে এবং মনে করে আমি যা বুঝি তাই ঠিক –এরাই বেশি আক্রান্ত হয়। আরেক বিবেচনায় বলা যায়, কাদিয়ানিদের দ্বারা নিরক্ষর ও মুর্খ মানুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়।

আরও পড়ুন : কাদিয়ানীদের পক্ষাবলম্বনকারী রেলমন্ত্রী সুজনের পদত্যাগ দাবি আলেমদের

ইসলাম টাইমস : মুসলমানের প্রতি কাদিয়ানিদের প্রথম দাওয়াত কী থাকে? কোন জায়গা থেকে তারা শুরু করে?
মাওলানা আবু সালমান : তারা শুরু করে উলামা বিদ্বেষ দিয়ে। তারা এভাবে মুসলমানের প্রতি মায়া প্রকাশ করতে থাকে। বলে, আজ সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা কতো কষ্টে আছে। অথচ উলামায়ে কেরাম কিছু তো করছেই না। উল্টো তারা দলবাজি করছে। সুতরাং আমাদের মুক্তির জন্য একজন রুহানি গুরু প্রয়োজন। এসব আলেমদের মাধ্যমে মুসলমানের কোনো উপকার হবে না। আর সেই রুহানি গুরু হলেন মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি।
তারা প্রাথমিক পর্যায়ে গোলাম আহমদ কাদিয়ানির নবুওয়াত দাবির বিষয়টি পুরোপুরি গোপন করে। দীর্ঘদিন ধরে কাদিয়ানি হওয়ার পরও অনেকেই জানে না গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নবী হওয়ার দাবি করেছিলো।
একটি হাদিস বিকৃত করে কাদিয়ানিদের বারবার শোনানো হয়, উলামায়ে কেরাম আসমানের নিচে ও জমিনের উপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী। যাতে মানুষের ভেতর উলামা বিদ্বেষ তৈরি হয় এবং উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে এসে সঠিক পথ না পায়।
এই কথাগুলো আবদুল করিম মুবাহালা নামের এক ব্যক্তি বলেছেন। যিনি ১৭ বছর কাদিয়ানি ছিলেন এবং বকশি বাজারের মূল কেন্দ্রেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। পরে আবার তওবা করে ঈমান এনেছেন।

ইসলাম টাইমস : শোনা যায়, কাদিয়ানিরা তাদের অনুসারীদের এবং কাউকে কাউকে কাদিয়ানি বানানোর জন্য বিপুল অর্থ সহায়তা দেয়।
মাওলানা আবু সালমান : অর্থের লেনদেন আছে। কিন্তু তাদের দাওয়াতের পুরো অংশ বা বড় অংশ অর্থ কেন্দ্রিক, আমার এমন মনে হয়নি। কোনো ব্যক্তি কাদিয়ানি হলে তার আয়ের ষোল ভাগের এক ভাগ কাদিয়ানি তহবিলে দিতে হয়। এটা তাদের বায়আতের অংশ। এই অর্থ কাদিয়ানিদের সার্বিক কল্যাণে খরচ হয়।
হ্যা, কাউকে কাদিয়ানি বানানোর টার্গেট থাকলে তার পেছনে ওরা অর্থ ব্যয় করে। এমন ঘটনা আমরা শুনেছি, একজন মুসলমান বিপদে পড়েছে। তার অর্থের প্রয়োজন। তখন কাদিয়ানিরা এগিয়ে এলো। তাকে ঋণ দিলো। আবার ঋণের বাইরে কিছু টাকা সহযোগিতা হিসেবেও দিলো।

ইসলাম টাইমস : কাদিয়ানি বিষয়ে বর্তমানে উলামায়ে কেরামের উদ্যোগ ও কার্যক্রম কোন পর্যায়ে রয়েছে?
মাওলানা আবু সালমান : দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বাংলাদেশে কাদিয়ানি ফেতনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হচ্ছে না। আগে আন্দোলন ছিলো। এখন তাও নেই। ব্যতিক্রম কিছু আলেম ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাদিয়ানি ফেতনা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কাজ করছেন।

আরও পড়ুন : পঞ্চগড়ে ইজতেমার নামে কী করতে চাচ্ছে কাদিয়ানিরা?

ইসলাম টাইমস : উলামায়ে কেরাম বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে কীভাবে কাজ করতে পারেন?
মাওলানা আবু সালমান : কাদিয়ানি বিষয়ে কাজের সূত্রে আমি মুরব্বিদের মুখে এই পরামর্শগুলো শুনেছি। তাহলো, কেউ কাদিয়ানি হয়ে গেলে তাকে ডেকে এনে বা তার কাছে গিয়ে বোঝানো। ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া। কাদিয়ানি প্রভাবিত এলাকায় অনুষ্ঠিত ওয়াজ-মাহফিল ও মসজিদে খতমে নবুওয়াতের উপর বেশি বেশি আলোচনা করা এবং দালিলিকভাবে আলোচনা করা। গরম ভাষায় আলোচনা বা দাবি জানানো খুব বেশি উপকারী নয়।
কাদিয়ানি ইবাদতখানায় একজন করে মুয়াল্লিম বা প্রচারক থাকেন। তিনি কাদিয়ানিদের মধ্যে ও মুসলমানদের মধ্যে ‘দাওয়াতি’ কাজ করেন। সুতরাং এর বিপরীতে আমাদেরও কাদিয়ানি প্রভাবিত অঞ্চলে প্রশিক্ষিত আলেমকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া অথবা মাদরাসার শিক্ষকদের এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেন তারা ঐ অঞ্চলে কাজ যথাযথভাবে কাজ করতে পারেন।
মির্জা আহমদ কাদিয়ানির ব্যক্তিত্ব ছিলো অত্যন্ত নিচু মানের। যা একজন নবী তো দূরের কথা একজন সাধারণ ব্যক্তিত্ববান মানুষেরও হওয়ার কথা নয়। তার চরিত্র নিয়েও অনেক অভিযোগ আছে। উলামায়ে কেরাম এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

আরও পড়ুন : সাতক্ষীরার সফরে দেখে এলাম কাদিয়ানি পল্লী

ইসলাম টাইমস : উলামায়ে কেরাম কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানান। কিন্তু অমুসলিম ঘোষণা করলে কি তাদের কার্যক্রম থেমে যাবে?
মাওলানা আবু সালমান : রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার প্রথম উপকার হলো ব্যাপকভাবে মানুষ তাদের অমুসলিম হওয়ার বিষয়টি জানতে পারবে। তারা তখন মুসলিম পরিচয় দিয়ে কাউকে প্রতারিত করতে পারবে না। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যারা কাদিয়ানি হয়ে যাচ্ছে তাদের বড় অংশই জানে না কাদিয়ানি মতবাদ গ্রহণের কারণে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও পাকিস্তানে তাদের মতবাদ প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করলে এই নিষেধাজ্ঞা বহাল হতে পারে।

ইসলাম টাইমস :সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাওলানা আবু সালমান : আপনাকে এবং ইসলাম টাইমস পরিবারকে ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।

পূর্ববর্তি সংবাদখাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধকে ‘একটি বড় দুর্নীতি’ আখ্যা দিলেন হাইকোর্ট
পরবর্তি সংবাদ২০ ও ১২ হাজার টাকা বাড়িয়ে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা