মুহাম্মাদ আদম আলী ।।
শিরোনাম শুনেই অনেকে হয়তো অবাক হবে। মানুষ এসব নিয়ে লেখা বেশি পড়তে চায় না। মৃত্যু, কবর, কাফন-দাফন এড়িয়ে চলতে চায় সে। বাঁচার জন্য এসব মনে না করাই এখন ফ্যাশন। কিন্তু মৃত্যু তো আর এড়ানো যায় না। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যে জীবন, সে জীবনে মৃত্যু কখনো অবহেলিত নয়। সেটিই বাঁচার উপকরণ হয়ে ওঠে। অসীম-অনন্ত জীবনের পথে না মরে পা বাড়ানো যায় না। মূলত সেটিই আসল জীবন। এজন্য কবরের অবকাঠামো গভীরভাবে মনে স্থান পায়, রেখাপাত করে—চব্বিশ ঘণ্টা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। গন্তব্য পরিষ্কার। এজন্য জীবন হয় বিনয়ের, আমলের। গোনাহ তাকে স্পর্শ করলেও হার মানে। দুঃখ তাকে পাশ কেটে চলে যায়। অন্তর এক অনাবিল সুখে সাঁতার কাঁটে—কাঁটতেই থাকে। এমন মানুষ কোথায়? প্রফেসর হযরত ঠিক তেমনি এক মানুষ।
ষাট পেরুলেই মানুষ বৃদ্ধ হয়। আশি পেরুলে? অতি বৃদ্ধ হবে নিশ্চয়ই। প্রফেসর হযরত এখন সেরকম। অতি বৃদ্ধরা নড়াচড়া তেমন করতে পারনে না। ঘরে বসে থাকেন। তার মতো কিংবা তার কাছকাকাছি অসুস্থ হলেও যে কেউ ঘরে বসেই সময় কাটাত। তিনি কাটান না। শক্ত-সবল যখন ছিলেন,তখনকার রুটিন এখন একটু পাল্টেছে। তবে কিছু ব্যাপার একদম অবিকল আগের মতোই আছে। এর একটি হচ্ছে কারও কাফন-দাফনে ছুটে যাওয়া।
হযরতের আত্মীয়-স্বজন মুন্সিগঞ্জ, ব্রাক্ষনবাড়িয়া এবং ঢাকার আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। আত্মীয়-স্বজনের কেউ এমন নেই যার জানাযায় হযরত যাননি। কেবল জানাযা নয়, একেবারে দাফন করা পর্যন্ত কবরস্থানে অবস্থান করেছেন। সুস্থ থাকতে কবরেও নেমেছেন। এখন আর কবরে নামতে পারেনা না। কবরের পাশে বসে বসে দাফন কার্য তদারকি করেন। আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী ও সহকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক—কারও জানাযাই বাদ যায় না। সব জায়গায়ই রুটিন এক। জানাযা থেকে লাশ দাফন পর্যন্ত হযরত উপস্থিত থাকেন। লাশ দাফনের জন্য কত দুর্গম পথ যে তিনি সফর করেছেন! কোথাও জানাযায় যেতে না পারলে পরদিন মৃতের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন, দুআ করেছেন, চোখের পানি ফেলেছেন। এখনো একই কাজ করে যাচ্ছেন।
এই সেদিন তার এক পড়শি ইন্তেকাল করেছেন। একই দিনে তার এক আত্মীয়ও আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছেন। আত্মীয়ের বাসা ঢাকার বাইরে। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সম্ভবত পড়শির জানাযা পাবেন না। এজন্য জানাযার দায়িত্ব দিয়েছেন মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবকে। প্রফেসর হযরত গাড়ি পাঠিয়ে তাকে সেই হযরতপুর থেকে নিয়ে এসেছেন। বাদ এশা জানাযা হয়েছে। লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হযরতের ফিরতে দেরিই হয়ে গেল। খুব আশা ছিল জানাযা পাবেন। পাননি। দাফন করার সময় কবরস্থানে এসে হাজির হয়েছেন। কবরস্থানের রাস্তা সরু। দুজনে ভর দিয়ে হাঁটা যায় না। হুইল চেয়ারে এসেছেন। লাশ তখনো কবরে নামানো হয়নি। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। প্রফেসর হযরত গিয়ে তার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন। লোকজন অপেক্ষা করছে। লাশ আনা হলো। সুন্নাত তারিকায় শোয়ানো হলো। হযরতসহ সবাই কবরে মাটি দিতে শরীক হলেন। কবরস্থানে দায়িত্বে থাকা দুজন বুড়ো লোক এখন কবরের মাটি সমান করছে। এতে সময় লাগে। এ সময় অপেক্ষা করা কঠিন। অনেকে চলেও গেল। প্রফেসর হযরত কবরের দিকেই তাকিয়ে আছেন। নযর কিছুক্ষণের জন্যও অন্যদিকে সরাননি।
এবার দুআ হবে। কবরকে সামনে রেখে দুআ করা নিষেধ। একটু সরে গিয়ে পশ্চিম দিকে ফিরে হযরত দুআ করেন। পশ্চিম দিকে বেশি জায়গা ছিল না। এজন্য সবাই নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে ফিরে দুআ করলেন। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহবে দুআ পরিচালনা করলেন। দুআ শেষ করে সবাই নিজ নিজ বাড়ির দিকে পথ ধরলেন।
এত দীর্ঘ সময় আমার কবরস্থানে থাকা হয় না। জানাযার নামাযে শরীক হয়েই এক কিরাত নেকীতে খুশি হয়ে যাই। লাশের সঙ্গে কবরস্থানে যে কয়বার ছিলাম, তা-ও প্রফেসর হযরতের সঙ্গেই। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু আত্মীয়-স্বজনকেও দাফন করেছি। তবু এ কাজে আমাদের আগ্রহ খুবই কম। আমরাও বেঁচে থাকতে মরার কথা ভাবতে চাই না!