প্রাচীন যুগের সীরাত রচনা-২: সীরাতে ইবনে ইসহাক

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ।।

দ্বাদশ হিজরীতে দ্বিতীয় খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফত আমলে কুফার পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ‘আইনুত তামর’ (একটি শহর) বিজিত হয়। সেখানের যেসকল যুদ্ধবন্দীদেরকে মদীনায় আনা হয় তাদের একজন ছিলেন ‘ইয়াসার’। যার বংশে হিজরী ৮৫ সনে জন্মগ্রহণ করেন জগদ্বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থকার মুহম্মাদ ইবনে ইসহাক রহ.। তিনি সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং কিবারে তাবেঈদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের থেকে বিপুল পরিমাণ হাদীস বর্ণনা করে হাফেযে হাদীসের মর্যাদা লাভ করেন।

তার বিখ্যাত উস্তাযগণের মধ্যে রয়েছেন হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ., ইমাম যুহরী রহ. ও আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. প্রমুখ তাবীয়ী মনীষীগণ।

তাঁর শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন হযরত আলী ইবনুল মাদীনী রহ., ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আল-কাত্তান রহ., ইমাম শুবা রহ. ও সুফিয়ান সাওরী রহ.সহ পৃথিবীখ্যাত মুহাদ্দিসগণের এক জামাত।

সহীহ বুখারী (তালীক হিসাবে), সহীহ মুসলিম (মুতাবাআত হিসাবে), সুনানে আরবাআ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে তাঁর সূত্রে বহু হাদীস বর্ণিত রয়েছে।

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রহ. যেমন ছিলেন বরেণ্য মুহাদ্দিস তেমনি বিদগ্ধ ঐতিহাসিক। তাঁর রচিত তিনটি কিতাবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘আল-মুবতাদা’, ‘আল-খুলাফা’ ও ‘আস-সিয়ারু ওয়াল মাগাযী’। তৃতীয় কিতাবটিই পরবর্তীতে ‘সীরাতে ইবনে ইসহাক’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

বর্ণিত আছে—তিনি একবার বাগদাদে খলীফা মানসুরের দরবারে প্রবেশ করেন। তখন মানসুরের সামনেই ছিল তার পুত্র (পরবর্তীতে খলীফা) মাহদী। খলীফা বললেন, ইবনে ইসহাক! আপনি এই ছেলেটিকে চেনেন?

ইবনে ইসহাক রহ. বললেন, হ্যাঁ। আমীরুল মোমিনীনের ছেলে।  খলীফা বললেন, আপনি ওর জন্যে এমন একটি কিতাব রচনা করেন যাতে হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বর্ণনা থাকবে।

হযরত ইবনে ইসহাক রহ. খলীফার আবেদন রক্ষা করে কিতাব রচনার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘদিন পর কাজ সমাপ্ত হলে কিতাবটি খলীফার সামনে পেশ করেন। সুদীর্ঘ সেই কিতাব দেখে খলীফা বললেন, ইবনে ইসহাক! আপনি খুবই দীর্ঘ করে ফেলেছেন। কিছুটা সংক্ষেপ করুন। এই বলে কিতাবটি রাষ্ট্রীয় সংরক্ষাণাগারে রেখে দেন। (মুহাক্কিক আবদুস সালাম হারূনকৃত ‘তাহযীবু সীরাতে ইবনে হিশাম’ এর ভূমিকা। পৃষ্ঠা : ৯)

হযরত ইবনে ইসহাক রহ.-এর সেই সংক্ষিপ্ত কিতাবটিই আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’। যা ‘সীরাতে ইবনে ইসহাক’ নামে প্রসিদ্ধ।

তাতে তিনি হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীকে প্রাধান্য দিয়ে পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি ও নবী রাসূলদের ইতিহাস লিখেছেন। আদ সামূদসহ বিভিন্ন জাতির মাঝে প্রসিদ্ধ কাব্য-কবিতাও সংকলন করেছেন।

এক্ষেত্রে কোথাও সনদ ও সূত্র উল্লেখ করেছেন। কোথাও করেননি। কোথাও বর্ণনা করেছেন বিচ্ছিন্ন সূত্রে। বলেছেন, ‘অমুক গোত্রের একলোক ঘটনাটি আমাকে শুনিয়েছেন’, ‘একজন আহলে ইলম এটি বর্ণনা করেছেন’, ‘মক্কার অধিবাসী একজন বলেছেন’ এভাবে। সেজন্য অযাচিত অনেক বিষয় ও কিচ্ছা কাহিনী তাতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে। তাই পরবর্তী উলামায়ে কেরাম তার এ কিতাবের বিভিন্ন অংশের কঠোর সমালোচনা করেছেন। উম্মতকে তাতে বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনী গ্রহণ করা থেকে সতর্ক করেছেন।

কোনো কোনো মনীষী ইবনে ইসহাক রহ.-এর সেই কিতাবটিকে সম্পাদনা করে নতুনভাবে সাজিয়েছেন। কিংবা সেই কিতাবের আলোকে নতুন কিতাব রচনা করেছেন। এক পর্যায়ে হুবহু সেই কিতাবটি আর সংরক্ষিত থাকেনি। যা আছে তা পরবর্তীদের সংকলনগুলো থেকেই বিন্যস্ত করা।

মোটকথা, হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রহ. সীরাত শাস্ত্রের ইমাম পর্যায়ের একজন মনীষী। তাঁর সীরাত গ্রন্থটি পরবর্তী বহু গ্রন্থের উৎস।

কিতাবটি বর্তমানেও ছাপা পাওয়া যায়। দুই খণ্ডে প্রকাশিত বৈরুতের দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যার সংস্করণটি বেশি প্রসিদ্ধ।

পূর্ববর্তি সংবাদআবরারের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের নির্দেশ, প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা
পরবর্তি সংবাদসুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেশ করুন, প্রমাণিত হলে আমরা ভিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব : নওফেল