আল কুরআনে হযরত ঈসা আ.

মুফতি যুবায়ের আহমদ   ।।

পূর্ববর্তী নবী-রাসুল ও ঐশী গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে মৌলিক বিশ্বাস রাখা ইসলাম ধর্মে ইমানের অপরিহার্য শর্ত। প্রত্যেক ধর্মানুরাগী সত্যানুসন্ধানী সৎ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে ঈসা (আ.) একজন মহান ব্যক্তি ও নবী। বিশেষ করে খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে তিনি সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত। তাঁর সম্পর্কে উভয় ধর্ম গ্রন্থ- ইঞ্জিল ও কোরআনে বিভিন্ন সাদৃশ্যমূলক বিষয় বিদ্যমান। খ্রিস্টানদের কাছে তিনি যিশু খ্রিস্ট। আর মুসলমানের কাছে তিনি হজরত ঈসা (আ.) হিসেবে গণ্য।

ঈসা (আ.)-এর জন্ম

ঈসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসুল। আল্লাহ তায়ালা আপন শক্তিতে পিতা ছাড়া তাঁকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘যখন ফেরেশতাগণ বলল, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বাণীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ-ঈসা ইবনে মারইয়াম; দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। যখন তিনি মায়ের কোলে থাকবেন এবং পূর্ণ বয়স্ক হবেন, তখন তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। আর তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোনো পুরুষ-মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন, এভাবেই। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোনো কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হয়ে যাও’, অমনি তা হয়ে যায়।’ (সুরা আলে ইমরান : ৪৫-৪৭)

এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) ও তাঁর সম্মানিত মা মারইয়াম (আ.) সম্পর্কে সুরা মারইয়ামের ১৬ থেকে ৪০ নম্বর আয়াত পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

ঈসা (আ.)-এর দৃষ্টান্ত

‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাঁকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন এবং তারপর তাঁকে বলেছিলেন, ‘হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে গেলেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৫৯)

ঈসা (আ.) ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত রাসুল

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মারইয়াম-তনয় মসীহ রাসুল ছাড়া আর কিছু নয়। তার আগে বহু রাসুল অতিক্রান্ত হয়েছে আর তার জননী একজন ‘ছিদ্দীকা’-ওলি। তাঁরা উভয়েই খাদ্য ভক্ষণ করত। দেখুন, আমি তাদের জন্য কিরূপ যুক্তি-প্রমাণ বর্ণনা করি, আবার দেখুন, তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে।” (সুরা মায়েদা : ৭৫)

ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ছিলেন

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মসীহ্ আল্লাহ্র বান্দা হওয়াকে কখনো লজ্জার বিষয় মনে করে না এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারাও না। বস্তুত যারা আল্লাহর দাসত্বে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন।’ (সুুরা আন নিসা : ১৭২)

ঈসা (আ.)-এর শিক্ষা

ঈসা (আ.)-কে অনেকে ‘আল্লাহ’র আসনেই বসিয়ে থাকেন এবং তার উপাসনা করেন। এমন করা উচিত নয়, তা আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোরআনে কারিমে বলেন- ‘তারা কাফির, যারা বলে যে মরিয়ম- তনয় মসীহ-ই-আল্লাহ; অথচ মসীহ বলেন, হে বনি-ইসরাইল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা মায়েদা : ৭২)

ঈসা (আ.) নিজেকে প্রভু বলেননি

ঈসা (আ.)-কে অনেকে প্রভু বলে বিশ্বাস করে থাকেন, এমন বিশ্বাস করা সঠিক নয়। কারণ ঈসা (আ.) নিজেকে কখনো ঈশ্বর বলে দাবি করেননি। সুরা মায়েদার ১১৬-১২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘যখন আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদের বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য সাব্যস্ত করো? ঈসা বলবেন; আপনি পবিত্র। আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। যদি আমি তা বলতাম, তবে আপনি অবশ্যই জানতেন; আপনি তো আমার মনের কথাও জানেন কিন্তু আপনার গুপ্ত বিষয় আমি জানি না। নিশ্চয় আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত।

আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, শুধু সে কথাই বলেছি, যা আপনি বলতে আদেশ করেছিলেন। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করো- যিনি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক। আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সব বিষয়ে পূর্ণ পরিজ্ঞাত।’ (সুরা মায়েদা : ১১৬-১১৭)

ঈসা (আ.)-এর ভাষায় সঠিক পথ

ঈসা (আ.)-এর ভাষায় সঠিক পথ হলো এক আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ঈসা যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ আগমন করল, তখন বলল, আমি তোমাদের কাছে প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ, তা ব্যক্ত করার জন্য এসেছি। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার কথা মানো। নিশ্চয়ই আল্লাহই আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তাঁর এবাদত করো। এটা হলো সরল পথ।’ (সুরা আয যুখরূফ : ৬৩-৬৪)

ঈসা (আ.)-এর অলৌকিক ক্ষমতা

আল্লাহ তায়ালা বলেন- … ‘তুমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, দোলনায় এবং পরিণত বয়সেও এবং যখন আমি তোমাকে গ্রন্থ, প্রগাঢ় জ্ঞান, তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছিলাম এবং যখন তুমি কাদামাটি দিয়ে পাখির প্রতিকৃতির মতো প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে আমার আদেশে। অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখি হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদের বের করে দাঁড় করিয়ে দিতে এবং যখন আমি বনি-ইসরাঈলকে তোমাদের থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফির ছিল, তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছুই নয়।

আর যখন আমি হাওয়ারিদের মনে জাগ্রত করলাম যে আমার প্রতি এবং আমার রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, তখন তারা বলতে লাগল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে আমরা আনুগত্যশীল।’ (সুরা আল-মায়েদা : ১১০-১১১)

ঈসা (আ.) কি তিনের এক?

কেউ কেউ বলেন, ‘যিশু তিনের এক’! আল্লাহ তায়ালা কোরআনে হাকিমে ইরশাদ করেন- ‘তারা কাফির, যারা বলে যে মারইয়াম-তনয় মসীহ-ই আল্লাহ; অথচ মসীহ বলেন, হে বনি-ইসরাইল, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, যিনি আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই। নিশ্চয় তারা কাফির, যারা বলে, আল্লাহ তিনের এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। যদি তারা তাদের উক্তি থেকে নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরে অটল থাকবে, তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পতিত হবে।’ (সুরা আল-মায়েদা : ৭২-৭৩)

ঈসা (আ.) শূলীবিদ্ধ হননি; তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর তাদের এ কথা বলার কারণে যে আমরা মারইয়াম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল। অথচ তারা না তাকে হত্যা করেছে, আর না শূলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এক রকম ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুত তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এ ক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধু অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোনো খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তারা তাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা : ১৫৭-১৫৮)

 

কিয়ামতের আগে ঈসা (আ.)-এর আগমন

অসংখ্য হাদিসের আলোকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে কিয়ামতের আগে ঈসা (আ.) আবার পৃথিবীতে আসবেন। আল কোরআনেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আহলে কিতাবের যত শ্রেণি রয়েছে, তারা সবাই (কিয়ামতের আগে) ঈসার ওপর ইমান আনবে, ঈসার মৃত্যুর আগে।’- (সুরা নিসা, আয়াত : ১৫৯)। এ আয়াতের দু’টি ব্যাখ্যা রয়েছে।

প্রথম ব্যাখ্যা হলো, প্রত্যেক ইহুদিই তার অন্তিম মুহূর্তে যখন পরকালের দৃশ্যাবলি অবলোকন করবে, তখন ঈসা (আ.)-এর নবুয়তের সত্যতা উপলব্ধি করবে। কিন্তু তখনকার ইমান তাদের আদৌ কোনো উপকারে আসবে না। এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, কিয়ামতের নিকটবর্তী যুগে ঈসা (আ.) আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন। তখন ইহুদি-খ্রিস্টানরা মুসলমানদের মতো বিশুদ্ধ বিশ্বাস নিয়ে ইমানদার হবে। আর যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে।- (মা’আরেফুল কোরআন)

লেখক : পরিচালক, ইসলামী দাওয়াহ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ

পূর্ববর্তি সংবাদঝালকাঠি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান, নগদ দুই লাখ ১৪ হাজার টাকা উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদভারতে নতুন সংকট : শুরু হচ্ছে মুসলিম বিরোধী আদম শুমারি