ঐতিহাসিক বদর বিজয়: ত্যাগের চেতনা আমরা কতটা ধারন করতে পেরেছি

আরজু আহমাদ ।।

মদিনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৮১ মাইল পেরুলেই বদর উপত্যকা। আর এখানেই ইসলামের প্রথম দিককার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয়। কুরাইশদের পক্ষে মোট নয় শ’ পঞ্চাশজন যোদ্ধা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

তাদের সাথে ছিল দু’শ জন অশ্বারোহী। প্রায় সমসংখ্যক উষ্ট্রারোহী আর এই উভয় সংখ্যার সমান ছিল পদাতিক সৈন্য। রণসাজে সজ্জিত প্রত্যেকেই উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে ছিল সমৃদ্ধ। ৬০০ লৌহ বর্ম ছিল তাদের।

অপরদিকে মুসলমানদের সাকুল্যে যুদ্ধযাত্রা করেছিল ৩১৩ জন এর মধ্যে ৮ জন ছিল রসদ সরবরাহকারী, অর্থাৎ যোদ্ধা ছিল ৩০৫ জন। অস্ত্র বলতে উল্লেখ করার মত কিছুই ছিল না।

লৌহ বর্মের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সর্বাধিক সংখ্যা জানা যায় মাত্র ৬০ টি। অশ্বারোহী সর্বোচ্চ দুজন। এমনকি উমাবীর বর্ণনা থেকে জানা যায় অশ্বারোহী ছিল মাত্র ১ জন। উট ছিল মাত্র ৭০ টি।

কুরায়শরা এ যুদ্ধের যাত্রাপথে ৯ জায়গায় যাত্রাবিরতি করে। আর এই সময় তাদের আহারের জন্য ১০ টি করে উট জবাই করা হয়, কেবল দুদিন ৯ টি উট জবাই করা হয়েছিল। অর্থাৎ সৈন্যদের উন্নত খাবার পরিবেশন করতেই তারা ৮৮ টি উট জবাই করেছিল।

অপরদিকে যুদ্ধে মুসলমানদের সামগ্রিক উটের সংখ্যাও ছিল এরচে’ কম। খাবারে বিলাস তো দূর। প্রায় অর্ধাহারে যুদ্ধযাত্রা করতে হয়েছে। শুকনো রুটি আর যবের ছাতুই ছিল একমাত্র খাদ্য রসদ।

বদর যুদ্ধের সংখ্যার এই পরিমাণকে আমরা সবাই জানি। ফলে কেবল ইতিহাসকে পড়ার ভঙ্গিতে পড়ে গেলে এ যুদ্ধটিকে ঠিকমত অনুধাবন করা যাবে না। নিজেকে ঐ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে চিন্তা করতে হবে।

এই দূর্দান্ত অসম যুদ্ধযাত্রায় যদি আমাকেও শরিক হতে হত? আমার ঈমান কি সেই শক্তির যোগান দিতে পারত? এই প্রশ্ন নিজেকে করলে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। এই চরম অসম যুদ্ধেও মুসলমান বিজয় লাভ করেছিল।

আদতে বদরের শিক্ষা হচ্ছে মুসলমান যে সর্বাবস্থায় কেবলই আল্লাহ্‌র সাহায্যের মূখাপেক্ষী তা অনুধাবন করতে পারা। বদর যুদ্ধের আগে আল্লাহ্‌র রাসুল ﷺ দোয়া করলেন,

‘ও আল্লাহ্‌! যদি আমরা পরাজিত হই, তবে এই পৃথিবীতে আপনার ইবাদাত করার আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’

আল্লাহ্‌ এই দোয়া কবুল করেছিলেন। তিনি কোরআনে আয়াত নাজিল করে বললেন,

(إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ)

‘তোমরা যখন তোমার প্রতিপালকের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে। তখন তিনি তা মঞ্জুর করেছিলেন।’

আমাদের একটা বড়ো সংকট হচ্ছে, রব্বের সাথে বান্দা হিসেবে এই সম্পর্কের কথা আমরা ভুলে যাই। দুনিয়ার নানাবিধ ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমীকরণ নিয়েই কেবল আমরা চিন্তিত থাকি। দোয়াও যে অনেক বড়ো শক্তি তা আমাদের চিন্তায় থাকে না।

আল্লাহ কোরআনে স্পষ্টত এই বিজয় প্রসঙ্গে বলছেন, তোমরা তাদেরকে পরাজিত করো নি-বরং আমিই করেছি। (সূরা আনফাল, ১৮) ফলত এই শক্তিই যে সবচে’ পোক্ত শক্তি তা আমরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই।

ফলত রব্বের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তোলার চিন্তাই থাকে না। রব্বের সাথে এই সম্পর্ক হীনতাই আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক যাবতীয় ব্যর্থতার কারণ সেটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।

ফলে আমাদের মনে গৎবাঁধা একটা ধারণা আছে। আমরা মনে করি, মুসলমানদের যে পতন তার একমাত্র কারণ মুসলমানের বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতির চর্চা থেকে সরে যাওয়াটা। এই চিন্তা একটা দিক থেকে দেখলে ভয়াবহ।

এই চিন্তা মূলত ইসলামের যে মৌলিক ভিত্তি- যাবতীয় কাজে আল্লাহ্‌র মূখাপেক্ষিতা, সেই বোধের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বস্তুত ইসলামের কোনও বিজয় কখনোই দুনিয়ার শক্তির উপর ভিত্তি করে কোনও কালেই হয় নি।

ইসলাম এই দুনিয়ায় তার প্রারম্ভে কিছু দুর্বল মানুষকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এবং যাদের নেতৃত্বে ছিলেন একজন ‘জাগতিক শিক্ষাহীন’ একজন ‘নিরক্ষর নবী’। সেকালের শিল্প ও বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ পারস্য আর হাজার বছরের প্রতাপশালী রোমের সাথে তাঁরা লড়াই করেছিলেন।

তাঁদের একমাত্র ভিত্তি ও শক্তি ছিল আল্লাহ্‌। ইসলামের নিরঙ্কুশ অনুসরণই তাদেরকে করে তুলেছিল দুনিয়ার শেষ্ঠতর শক্তি। বরং বাস্তবতা হচ্ছে এটাই, উম্মতের যখন পতনের দিন শুরু হয়েছিল তখন মুসলমান ছিল সংখ্যায় বিশাল, বিজ্ঞানে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতর, শিল্পে আকাশচুম্বী।

তবুও তাদের পতন থমকে থাকে নি। সব বিলাস, সব সমৃদ্ধি খয়ে গিয়েছিল। স্পেনের কথাই ধরা যাক। মুসলিম স্পেন কি কম সমৃদ্ধ ছিল? শিল্প, বিজ্ঞান, কলায় তারাই তখন ছিল শ্রেষ্ঠ। তবুও পতন হয়েছে।

ইতিহাসে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ইসলামী ভূমির সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটেছে আবু বকর রা. থেকে শুরু করে ১২ তম খলিফা পর্যন্ত। দেখবেন, তখন মুসলিম ভূমিতে বিজ্ঞানের চর্চা শুরুই হয় নি। শুরু হয়েছে এর পরে। কিন্তু যা ছিল তা হচ্ছে, নিরঙ্কুশ তাকওয়া, খোদাভীতি।

এককালে মুসলিম শাসনাধীনে থাকা গ্রিস, আর্মেনিয়া, অস্ট্রিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, তাতারিস্তান, সাইপ্রাস, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া , স্লোভেনিয়া, ইতালির সিসিলি থেকে চীনের সিংকিয়াং।

এই যে দীর্ঘ হারানোর মিছিল। তা কি স্পেন মডেল থেকে ব্যতিক্রম ছিল? তাদের সায়েন্টিফিক, ইকোনোমিক, কালচারাল এস্টাব্লিশমেন্ট ছিল। তবুও উম্মত কেন চিরতরে এই ভূমিগুলো হারিয়েছে?

আদতে এটা একটা রীতি। একটা খোদায়ী ফায়সালা। কেন এই পতন, এই দুর্ভাগ্যের ফায়সালা আসে? খিলাফতের জন্য অন্যতম যে শর্ত, ‘আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ’। অর্থাৎ নবী ﷺ এঁর পূর্ণ আদর্শের উপর অবিচল থাকা।

যখনই এর খেলাফ হয়েছে আর তা দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে তখনই এই পতনের ফায়সালা এসেছে। আজকে মুসলমান মার খাচ্ছে তামাম দুনিয়ায়, এটাও কিন্তু এ জন্য নয় যে, তারা বিজ্ঞানে কিম্বা শিল্পে, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে।

বরং এই মার খাওয়ার, এই পতনের কারণ তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে। মুসলমান তাকওয়ার মধ্যে ফিরুক, বিজয় আবারও তার পদলেহন করবে। পতনের এই ক্রম ধারা উল্টে যাবে।

আমি বলছি না বিজ্ঞানের চর্চা মুসলমান করবে না। অবশ্যই তা করবে। কিন্তু রব্বের সাথে সম্পর্কহীন হলে বস্তুগত কোনও উন্নতিই আমাদের কাজে আসবে না। এই ভিতটা নড়বড়ে হলে উম্মতের পতন ঠেকানো কিম্বা বিজয় অসম্ভব।

বদর এই উম্মতের অসংখ্য ঐতিহাসিক শিক্ষা অর্জনের জায়গা। যতবার যত গভীরভাবে পাঠ করা যায়, ততবারই নতুন নতুন কিছু শেখা যায়।

বদরের যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে যখন মল্লযুদ্ধে কাফিরদের পক্ষ থেকে লড়ার আহ্বান জানানো হয়। মুশরিকদের মধ্য থেকে লড়ার জন্য বেরিয়ে আসে তিনজন। দুই ভাই ওতবা ও শাইবা এবং ওতবার পুত্র ওলিদ।

নবী ﷺ প্রেরণ করেন প্রিয় চাচাত ভাই হজরত ওবায়দা, প্রিয়তর চাচা হজরত হামযা, চাচাত ভাই ও স্বীয় জামাতা আলিকে (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিচক্ষণ ও বীর যোদ্ধা।

রাসুল সা. অন্যদেরও বাছাই করতে পারতেন। কিন্তু উপস্থিত সাহাবাগণের মধ্য হতে তিনি এগিয়ে দেন নিকটতর স্বজনদের। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা’আলার পথে কী অনুপম ত্যাগ! নেতৃত্বের মহৎ আদর্শ, সর্বোত্তম গুণ ও শিক্ষা প্রদান।

এই যে প্রিয় স্বজনকে ত্যাগ করা, কুরবানি করা এটাও বদরের অন্যতম শিক্ষা। বদরের যে সব চেতনা আজ আমাদের মধ্যে বিলুপ্ত তার মধ্য এই কুরবানি, এই ত্যাগ- এই প্রিয় বিষয়গুলোকে আল্লাহ্‌র জন্য কুরবানি করার ব্যাপারটাই প্রধান।

আজ সতেরোই রমযান বদর দিবস। এই বদর দিবসে, এই পবিত্র রমযানে একটা বদ অভ্যেস যেটা নিজের কাছে প্রিয়- কিন্তু আল্লাহ্‌র কাছে অপছন্দ। তা কি কুরবানি করতে পারি না আমরা?

এভাবেই একটু একটু করে আমরা চূড়ান্ত কল্যাণের পথে পৌছুবার চেষ্টাটুকুন তো করতে পারি! এই আল্লাহভীতি, এই তওবা ক্রমশ রব্বের কাছাকাছি আসার পথ করে দিক আমাদের।

আল্লাহ্‌ আমাদের সব কথা, সব আহ্বান, সব আর্তনাদ শোনেন। তিনি নিজেই বলছেন,

إِنَّ اللّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী; সকল কিছুই অবগত।

লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া।

পূর্ববর্তি সংবাদহাজার ছাড়াল একদিনেই শনাক্তের সংখ্যা, নতুন মৃত্যু ১১ জনের
পরবর্তি সংবাদগুজবে কান দিবেন না, আমি বেঁচে আছি: অমিত শাহ