ভারতে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে ধর্মান্তরের প্রবণতা, কিছু বেদনাদায়ক অভিব্যক্তি

উম্মে হিশাম, মুম্বাই ।।

কিছু ব্যথা রয়েছে যা আমার নয়, কিন্তু তবুও আমাকে কাঁদায়। কিছু ফোস্কা রয়েছে যা অন্য মানুষের পায়ে থাকে, তবে তার যন্ত্রণা আমাকে অস্থির করে তোলে। অন্য কারও লাঞ্ছনা আমাকে আমার আঁচলে মুখ লুকিয়ে লজ্জিত হতে বাধ্য করে। সম্ভ্রম ও সতীত্বের একের পর এক জানাযায় আমি নিঃশব্দে কেঁদে ফিরি; কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করার মতো কেউ থাকে না।

জখম এক-দুটি নয়, পুরো শরীরই ক্ষতবিক্ষত। এই আধুনিক মনস্করা বলে, প্রদীপ আলোকিত হচ্ছে। আমি বলি, সেটি তো গলে যাচ্ছে! এবং তা নিঃশেষ হতে হতে প্রতি মুহূর্তে আমার অন্তর, আমার বাড়ি, আমার সমাজ সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।

যে ছিল চোখের আলো, হৃদয়ের শীতলতা, পিতার অহংকার, ভাইদের সম্মান, না জানি কখন তার অন্তরে এটা বসে গেছে যে, সে এই পৃথিবীতে আমাদের ওপর, আমাদের সমাজের ওপর একটি বোঝা। তার ধারণা, তার সারাজীবনের সাথে যুক্ত মানুষগুলোর বোঝাও তাকে কেন্দ্র করে।

এই সমস্ত চিন্তায় বিরক্ত হয়ে সে আমাদের সবার থেকে দূরে সরে গেছে। এতদূরে যে, তার পর্যন্ত আমাদের আওয়াজও পৌঁছে না। নিজের সৃষ্টিকর্তাকেও সে ভুলে গেছে।

‘কেউ আমার কাছে আমার রাজকন্যাকে ফিরিয়ে এনে দাও/আমার উঠোনের পাখিটি, যে তার পথ হারিয়েছে/ কেউ তাকে আমার ঘরের দরজাটি দেখিয়ে দাও।’

এই আওয়াজ এখন একটি ঘরের নয়, ভারতের প্রতিটি মুসলিম পরিবারের হৃদয়ের বিলাপ। এখনকার অহরহ সংবাদ এটাই যে, সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের বেদনাদায়ক অবস্থা অনুমান করাও এখন মুশকিল হয়ে গেছে।

অমুক বেচারি অমুসলিম ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, কোর্ট মেরেজ করে বসেছে অথবা মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে তাকে ধর্মান্তরিত করে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েদের কথা তো বাদই দিলাম, বিবাহিত নারীদের ঘটনাতেও মিডিয়া সয়লাব।

তাহলে এখন কী করণীয়? আর দশটি খবরের মতো এখবরটিকেও দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবেন, নাকি একজন মুসলিম হিসেবে নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করবেন? যে মানুষটির হৃদয়ে আত্মসম্মানের ছিঁটেফোঁটাও বাকি আছে, তিনি এসব ঘটনায় আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আসতাগফিরুল্লাহ-এর সঙ্গে অবস্থার শোচনীয়তা থেকে মুক্তির দোআও করবেন এবং আমলিভাবে নিজের সাধ্যমতো কর্তব্য পালনের নিয়তও করবেন।

জাতীয় ও দ্বীনী সংগঠনসমূহ, মসজিদ এবং মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সবার জন্য সময় এসে গেছে প্রকাশ্যে এসব ষড়যন্ত্রের পর্দাকে উন্মোচিত করা। যেখান থেকেই সম্ভব মানুষের কাছে নিজেদের কথা পৌঁছানো, বিষয়টির নাজুকতা তুলে ধরা এবং পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এর সমাধানে এগিয়ে আসা। আপনারা সাধারণ মুসলমানদেরকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করুন, এই ঘৃণ্য এবং স্পর্শকাতর সমস্যার কারণ ও ফলাফলের পাশাপাশি এ থেকে উত্তরণের উপায়ও বাতলে দিন।

যদি আমাদের কোনও মেয়ের ধর্ম ও সম্মান বর্বরদের কবলে পড়ে, তবে মনে রাখতে হবে, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলের দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে মুসলমানরা লাঞ্ছনা ও অপমানের অনুভূতিতে দগ্ধ হতে থাকে। যাতে তারা প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং উত্তেজিত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। বুঝতে হবে, যদি অন্যেরা আমাদের সম্মান নিয়ে খেলতে চেষ্টা করে তবে আমাদের সাহসীরা কি শুধু হাত বেঁধে বিনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবে? নির্লজ্জতা ও ধর্মভ্রষ্টতার এই সয়লাব বন্ধ করতে কি চিৎকার করে কথাও বলবে না?

সিরিয়ালের যুগ তো বহু পুরনো হয়ে গেছে। স্মার্টফোন এসে ক্যাবল এবং ডিশ টিভির ব্যবসাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। এখন প্রবীণ আর বৃদ্ধরা ছাড়া সিরিয়াল কেউ দেখে না। এখন তো ওয়েব সিরিজের যুগ। কোনো ধরনের সেন্সর ব্যতীত যা ইচ্ছে বিনা রাকঢাকে  ওয়েব সিরিজে দেখানো সম্ভব।

দু’মিনিট এবং পাঁচ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ভিডিওগুলির মাধ্যমে মানুষের অন্তরে এখন একথা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ‘‘আন্তর্ধমীয় বিবাহগুলি মানবব্যবস্থা এবং মানব সম্পর্কের একটি সুন্দর রূপ, তাই এতে কোনও দোষ নেই’’, ‘‘প্রেমের কোনো ধর্ম নেই’’, ‘‘প্রতিটি মানুষের  শরীরে ​​প্রবহমান রক্ত ​​একই রকম’’, ‘‘তার আবেগগুলি একই, তার সুখ ও দুঃখের রঙ একই, এমনকি তাঁর ঠোঁটের হাসি এবং তার চোখ থেকে প্রবাহিত অশ্রু একই .. তাই দুই প্রেমিক যুগলের মধ্যে এই ধর্মের দেয়াল কেন’’ ???

এসব সুড়সুড়িমূলক ফিল্ম যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয়তারও পাচ্ছে এবং পরিণামও বয়ে আনছে, তাই এই পরিস্থিতিতে আমাদেরও এই বিষের প্রতিষেধক খুঁজে বের করা কর্তব্য নয় কি? এধরনের মগজধোলাইমূলক ভিডিও যেভাবে তৈরি  হচ্ছে, তার চেয়ে কম হোক, কিন্তু সংশোধন ও গঠনমূলক কিছু প্রস্তুত করে নিজেদের মিডিয়া এবং সমস্ত প্রচারমাধ্যমের কার্যকর ব্যবহার করা অতীব প্রয়োজন। ইসলামী চ্যানেল এবং মিডিয়ায় যুক্ত প্রতিভাবান লোকেরা এগিয়ে আসুন এবং এসব ভিডিওর জবাবে এমন কিছু করুন, যাতে ইসলামের শত্রুরা যা কিছু কল্যাণকর হিসেবে প্রচার করছে, তার ক্ষতিকরতা তুলে ধরা যায়। মেয়েদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার ফলে যে কেয়ামতসম পরিস্থিতি পরিবারের লোকদের ওপর বয়ে যায়, তা তুলে ধরা প্রয়োজন। কারণ আবেগের প্রতিবাদ আবেগ দ্বারাই হয়।

কেবল বাবা-মা এবং অভিভাবকরা নন, আপনার আশপাশের প্রতিটি মুসলিম মেয়েকে নিয়ে আপনার চিন্তিত হওয়া উচিত, অন্যথায় বেচারা মা-বাবা শেষ পর্যায়ে গিয়ে টের পান যে, কী কেয়ামত তাদের সঙ্গে ঘটে গেছে। পরিস্থিতি বুঝেও চুপ করে বসে থাকা ঈমানদারের জন্য শোভনীয় নয়। একজন মুসলমান এবং তার সম্মানের সুরক্ষা দেওয়া অপর মুসলমানের কর্তব্য। তাই ব্যক্তিগত স্বার্থ, শত্রুতা চরিতার্থ করার জন্য উম্মতের বদনামের মাধ্যম না হই। যখনই কোনো ছেলেমেয়ের চলাফেরায় মন্দ কিছু দেখবেন, নিজে গিয়ে তার বাবা-মা ও অভিভাবকে জানিয়ে দিন তাদের অসন্তুষ্টি এবং তিরস্কারের পরোয়া না করে। ইনশাআল্লাহ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আপনাকে প্রভূত সম্মানে ভূষিত করবেন।

আর এখন যেহেতু শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার হাতে হাতে একটি করে স্মার্টফোন রয়েছে, তাহলে শুনুন, টিকটকের মতো এমন একাধিক অ্যাপ রয়েছে যেখানে অশ্লীলতা এবং বল্গাহীনতার লাখো দরজা ‘ফান’ ও বিনোদনের নামে খুলে রাখা হয়েছে। বহু মুসলমান কিশোর-তরুণী ঘরের বন্ধ দরজার পেছনে নিজের ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল করে ঘরে বসে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা মাসে উপার্জন করছে, এ পরিস্থিতিতে ইজ্জত ও সম্ভ্রমের জানাযা বের হয়ে যাওয়ার পথ একদম সহজ হয়ে গেছে।

কলেজ হোক অথবা ক্লাসরুম, বেডরুম হোক বা রাস্তায়- সবখানে এরা দেদারসে ভিডিও বানিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সেগুলো প্রচার করে অর্থ উপার্জন করছে, যত বেশি ভিউ ততবেশি টাকা, তো যখন চারিদিকে এমন উদ্দাম সংস্কৃতি তখন আবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত জীবন কার ভালো লাগে! এধরনের ভিডিও ভাইরালকারী এবং ভিডিও তৈরিকারীদের হার আশিভাগ উঠতি বয়সিদের এবং তারাও সবাই মুসলমান কম বয়সী যুবক-যুবতী! উঠতি যৌবনের সময়গুলোতে সন্তানের তত্ত্বাবধান-দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং বিনোদনের বিকল্প তাদের জন্য সরবরাহ করা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর জরুরি।

এখন প্রয়োজন তাদেরকে তাদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে জানানো। একজন মুসলমান হিসেবে তাদের ব্যক্তিত্বের সম্মান এবং মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করা। প্রয়োজন দ্বীনকে তাদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরা যাতে তারা বন্দিত্ব ভাবার পরিবর্তে নিজেদের ধর্মকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে এবং গর্ববোধ করে। তাদেরকে এমন শিক্ষা ও তরবিয়ত এবং দৃঢ় চিন্তা সরবরাহ করতে হবে যার মাধ্যমে তাদের কনফিডেন্স ও উদ্যোম সুগঠিত হয়। নিজেদের প্রতি তাদের আস্থা জন্মে এবং তারা সমাজে অন্যদের রঙে রঙিন হওয়ার পরিবর্তে নিজের স্বতন্ত্র দ্বীনী পরিচয় ধরে রাখতে পারে।

মেয়েদের ব্যাপারে একথা মনে রাখবেন যে, তাদের উত্তম শিক্ষা ও তরবিয়তের বিনিময়ে এমনি এমনিই জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়নি। এটা ফুল টাইম চাকরি যে, মেয়ে একটি হোক আর দশটি, তাদেরকে ভালোবাসুন, ভরসা করুন, আশ্বাস দিন, অযথা কঠোর ও রূঢ় হবেন না। তাদেরকে মুরতাদ হওয়ার দিকে ঠেলে দেবেন না।

মেয়েদের স্বভাব হচ্ছে মনোযোগ, ভালোবাসা ও স্নেহ লাভের। এটা যদি মাহরাম আত্মীয়দের কাছ থেকেই না পাওয়া যায়, তাহলে যেখানেই সে ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অনুভূতির সন্ধান পাবে সেখানেই সে হাত বাড়িয়ে দেবে। তখন আমাদের আফসোস করেও কোনো ফল হবে না। একজন যথার্থ বলেছেন,

کوئی تحریر جلائے تو دهواں اٹهتا ہے

دل وہ بهیگا ہوا کاغذ ہے جو جلتا ہی نہیں

‘কোনো কাগজ জ্বালালে তো ধুয়া ওঠে/ কিন্তু অন্তর হলো এমন ভেজা কাগজ, যা জ্বলেই না।’

ভাষান্তর: সাইফ নূর 

-এমএসআই

পূর্ববর্তি সংবাদজুমার দিন গোসলের বিধান
পরবর্তি সংবাদআজানে দুইবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন মুয়াজ্জিন!