মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী ।।
আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাবকে এমনভাবে গড়েছেন যে, মানুষ মাত্রই ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল। নিজের চারপাশে মানুষ এমন কাউকে খুঁজতে থাকে, যে তার সুখে সুখী হবে, যার অংশগ্রহণ তার সুখকে আরো বাড়িয়ে তুলবে; যার ঘনিষ্ঠতায় তার দুঃখ প্রশমিত হবে। এই আকর্ষণ সম্পূর্ণ স্বভাবজাত, খোদাপ্রদত্ত এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উর্ধ্বে। এটা ছাড়া আরেকটি সম্পর্কও আছে, যা মানুষ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে নেয়। সেটি হলো বৈবাহিক সম্পর্ক।
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নারী-পুরুষের পরিবার, অঞ্চল এবং ভাষা অভিন্ন হওয়া জরুরি নয়। অনেক সময় একেবারে অপরিচিতদের মাঝে সম্পর্ক হয়ে যায়। তবে এই সম্পর্ক এমন এক ভালবাসা ও প্রীতির জন্ম দেয়, যার গভীরতা প্রায়শই অন্য সব সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যায়; পুরনো সম্পর্কগুলো এর সামনে তুচ্ছ হয়ে যায়। এই সম্পর্কটি গুরুত্ববহ এই দিক থেকেও যে, উভয় পক্ষের ভবিষ্যত এমনকি মৃত্যু অবধি তারা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। এভাবে পরস্পর এক সময় বাবা-মা হয়। পারস্পরিক সহযোগিতায় সন্তানদের লালন-পালন করে। নিজেদের দেখা স্বপ্নগুলো এবার সন্তানদের মাঝে খুঁজে ফিরে।
এজন্য বিবাহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মাঝে সর্বাধিক সম্প্রীতি থাকা আবশ্যক। এই সম্প্রীতি সম্পর্ককে স্থায়ী করে তোলে। যারা তাৎক্ষণিক আসক্তি থেকে বিবাহের সম্পর্ক করে ফেলে তাদের এই সম্পর্ক বেশীরভাগ টিকে না। এই সম্প্রীতির জন্য আবশ্যিক শর্ত হল চিন্তা ও বিশ্বাসের মিলন। যে ব্যক্তি আল্লাহকে এক হিসাবে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহ ছারা অন্য কারও সামনে মাথা নত করাকে সবচেয়ে বড় অপরাধ মনে করে, তার চব্বিশ ঘন্টার জীবন কী করে মিলতে পারে এমন কারো সাথে যে কোটি প্রাণীর পূজা করে! দুজনের ধর্মীয় উৎসবকালে -যদি তারা নিজের আদর্শে অটল ও সত্যবাদী হয়, তবে- তাদের মধ্যে কোনও বিরোধ কি হবে না? বাচ্চাদের শিক্ষা-দীক্ষা এবং তাদের ধর্মীয় আনুষাঙ্গিক বিষয়াদীতে কলহ-বিবাদের পালা কি আসবে না? অবশ্যই আসবে! আর তাই ইসলামে যে বিষয়গুলিকে বিবাহের জন্য প্রতিবন্ধক বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো ‘ধর্মের ভিন্নতা’।
এই বিষয়টিকে সংক্ষেপে তিনটি ধাপে আলোচনা করা যায়, প্রথমত: কোনো মুসলিম মেয়ে অমুসলিম ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না, সে ইহুদি হোক বা খ্রিস্টান, অথবা কাফের বা মুশরিক। এর বাহ্যিক কারণ হল, যে কোনও মহিলার পক্ষে বৈরী পরিবেশে নিজের ঈমানকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত: একজন মুসলিম পুরুষ ইহুদি এবং খ্রিস্টান নারী ব্যতীত অন্য কোনো অমুসলিম নারীকে বিয়ে করতে পারবে না। হিন্দু নারীও এর অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়ত: মুসলিম পুরুষরা ইহুদি এবং খ্রিস্টান নারীদের বিবাহ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে: এক: ইহুদি ও খ্রিস্টান হওয়ার মানে সরকারের আদমশুমারিতে ইহুদি খ্রিস্টান হওয়া নয়; যেমনটি পশ্চিমা দেশগুলির বর্তমান অবস্থা। বরং তাকে একজন সত্যিকারের ইহুদি এবং খ্রিস্টান হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ, নবুওয়াত, কিতাব ও আখেরাতের ওপর অবশ্যই তার বিশ্বাস থাকতে হবে। দুই: ইহুদি ও খ্রিস্টান নারীকে বিবাহ করার সুযোগ থাকলেও তা কদর্য মুক্ত নয়। হজরত ওমর (রা.) যখন শুনলেন, সিরিয়ার মুসলিম পুরুষরা ইহুদি ও খ্রিস্টান নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে, তখন তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন। এর দুটি কারণ সুস্পষ্ট: এক. এতে করে মুসলিম পরিবারে অনৈসলামিক মনোভাব এবং ভিনসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের আশংকা রয়েছে। দুই. মুসলিমদের সীমানায় এমন নারীর অবস্থান রাজনীতি ও প্রতিরক্ষার দিক থেকেও অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
জেনারেল আকবর খান তার সিরাত বিষয়ক বই ‘প্রতিরক্ষার হাদীস’ এ এবিষয়ে তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন, ১৯৭৪ এর যুদ্ধে ইসরাইলের জয় ও মিশর-সিরিয়ার পরাজয়ের মূল কারণ এটাই ছিলো যে, বড় বড় কমান্ডারদের স্ত্রী ছিলো ইহুদী-খ্রিস্টান! ফলে মুসলিমদের যুদ্ধের সব গোপন কৌশল মুহুর্তেই পৌঁছে যেত ইসরাইলের কাছে।
আফসোস, আরবদের চোখ খোলেনি আজও। মিশরের বর্তমান স্বৈরশাসক সিসি’র মা একজন ইহুদি ছিলেন। এমনকি তার মামাও দীর্ঘকাল ইসরাইলের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। জর্ডানের বাদশার স্ত্রী ইহুদি। প্রয়াত ইয়াসির আরাফাতের স্ত্রীও অনুরুপ ছিলো। এটিই সেই বিপথগামী পদক্ষেপ যা মুসলিম দেশগুলিকে এতোটা দুর্বল করে দিয়েছে যে, তারা ইহুদি ও খ্রিস্টান শক্তিগুলির দিকে চোখ তুলে তাকানো বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খোলারও সাহস পায় না।
সুতরাং, সন্দেহ নেই যে, হযরত ওমর (রা.) মুসলমানদেরকে যে সতর্ক করেছিলেন তা তার ঈমানী বিচক্ষণতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির ভিত্তিতে ছিলো। যাই হোক না কেন, এক্ষেত্রে কোনও দ্বিমত নেই যে, মুসলিম নারী মুশরিক পুরুষকে বা মুসলিম পুরুষ মুশরিক নারীকে বিয়ে করতে পারবেন না।
দুর্ভাগ্যক্রমে, এই বাস্তব সত্য বিষয়টি সত্ত্বেও, ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ‘লাভ জিহাদ’ এর কল্পকাহিনী ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। ইসলাম যদি তা সমর্থন করতো এবং মুসলমানরা যদি বিবাহকে ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করতো, তবে অমুসলিম জাতির সাথে বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ হত না; বরং এতে উৎসাহিত করা হতো। যেমনটি আজ খ্রিস্টান বিশ্বে হয়ে থাকে। বরং কোনো নারী-পুরুষ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত কেবল বিশেষ কারো সাথে বিবাহের উদ্দেশ্যে মুসলিম হওয়াকেও ইসলাম সমর্থন করে না। নবিজির যুগে মদিনায় হিজরত করার বিধান থাকাকালে একজন মুসলিম স্বদেশপ্রেমর তাড়নায় মদীনায় হিজরত করতে চান নি। কিন্তু তিনি যে মহিলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সে তাকে মদীনায় হিজরত করার শর্ত করে। অবশেষে, তিনি হিজরত করেন। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পছন্দ করেন নি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ত অনুযায়ী হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত যার আছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য বিবেচিত। -অর্থাৎ আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন।- আর যে বিবাহ বা কোন পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, তার হিজরত সওয়াব লাভের যোগ্য নয়।’
সুতরাং কোনও ব্যক্তি মন থেকে ইসলাম গ্রহণ না করে কেবল এই উদ্দেশ্য যদি বিবাহ করে যে, আমি মুসলমান হলে অমুক ছেলে বা মেয়ের সাথে বিয়ে করতে পারবো, তবে সে কোনও সওয়াব না পাওয়ার বড় আশংকা রয়েছে। যদি সে এই অবস্থায় অবিচল থাকে, তবে তা এক প্রকার মুনাফেকি হবে। এবং আখেরাতে স্বভাবতই তার বাহ্যিক ঈমান তার মুখে ছুড়ে মারা হবে।
ভারতে মুসলিমরা সর্বদা হালাল ও হারামের সীমা রক্ষা করে চলেছেন। নির্ভরযোগ্য ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কখনও অমুসলিম মেয়েদেরকে বিবাহ করতেন না। অনেকে জৌধ বাই’র সাথে বাদশাহ আকবরের বিবাহের কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এই বিবাহ কেবল রাজপুতদের মনঃতুষ্টি লাভ বরং তাদের আগ্রহের ওপর ভিত্তি করেই হয়েছিল। আর আকবর কোনও আলেম বা দ্বীনদার মুসলমানও নয় যে তার কর্মের দায় সব মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
বাস্তবতা হল, যদি কোনো ছেলে বা মেয়ে মন থেকে কোনো ধর্ম গ্রহণ করে অতঃপর স্বধর্মীয় কাউকে বিয়ে করতে চায় তবে আমাদের দেশের আইন এর অনুমতি দেয়। এবং এটাকে ধর্মত্যাগের লক্ষ্যে বিবাহ বলা হয় না। বর্তমানে মিশ্র পরিবেশের প্রভাবে যদি কারও ভিনধর্মের কোনো মেয়ে বা ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকে, তবে এর সাথে ধর্মের কোনও যোগসূত্র নেই। অন্ততঃ ভারতে এই জাতীয় ঘটনা বহুকাল ধরে চলমান। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর পরিবারে এর দৃষ্টান্ত বিদ্যমান।
মজার বিষয় হল, যেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই কল্পকাহিনীকে সরিষাদানা থেকে পাহাড়ে পরিণত করেছে, তাদের ঘরেই বেশী ঘটছে এই জাতীয় ঘটনা। বিজেপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার কন্যা ও বোনেরা স্বেচ্ছায় বরং জোর করে মুসলমান পুরুষ বিবাহ করেছে। সেখানে এমনও দেখা গেছে, অনেক অমুসলিম পুরুষ মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছে এবং এমনও হয়েছে, প্রেমাসক্ত মুসলিম পুরুষ হিন্দু নারীকে বিয়ে করার জন্য ইসলাম থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র জগতেও এর অনেক উদাহরণ বিদ্যমান।
মূলকথা হল, ধর্ম প্রচারের চেতনায় নয় বরং প্রবৃত্তির তাড়নায় ঘটছে এসব ঘটনা। এক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানের মাঝে কোনও পার্থক্য নেই। এসব ঘটনাকে ‘লাভ জিহাদ’ নাম দেওয়া মিথ্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়ারই নামান্তর। ওলামায়ে কেরাম ও খতিবগণের দায়িত্ব হল, বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মুসলমানদের নতুন প্রজন্মকে অবহিত করা এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা, যেন কোনও মুসলিম কোনও অমুসলিমকে বিয়ে না করে। এটা মুসলিম সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা পাপ, শরিয়তের দৃষ্টিতেও এটা বিবাহ নয়। এটা সমাজের শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করে। তবে হ্যা, কোন হিন্দু ছেলে বা মেয়ে স্বচ্ছ দিলে মুসলিম হয়ে গেলে তাকে বিয়ে করা শরীয়ত সম্মত। এটা শরীয়তের বিধান। আর আমাদের দেশের আইনেও তা সুস্পষ্টভাবে অনুমোদিত।
অনুবাদ: নূরুদ্দীন আজিম
-এমএসআই