সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।।
ঐতিহ্যগত দিক থেকে তুর্কেমেনিস্তানের প্রসিদ্ধি দুই কারণে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঘোড়া পালন আর দৃষ্টিনন্দন কার্পেট তৈরি। আখাল-টেক নামের উন্নত প্রজাতির ঘোড়া পৃথিবীতে বিরল। তুর্কেমেনিস্তানসহ মধ্যএশিয়ার কয়েকটি দেশে খুব অল্প পরিমাণ ঘোড়া পরিপালন করে গড়ে তোলা হয়। তারপর সেগুলো অশ্ববিলাসী মানুষের কাছে বিক্রি করা হয় চড়া দামে।
তেমনি তুর্কেমেনিস্তানের হস্তনির্মিত দৃষ্টিনন্দন কার্পেটের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। সে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বছর ধরে চলে ফুলনকশার বাহারি কার্পেট বুননের কর্মযজ্ঞ। লতা আর ফুলে ছাওয়া নানা রংয়ের এসব কার্পেট বিক্রি হয় ইউরোপের বনেদি সব দোকানে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তুর্কমেনরা ধরে রেখেছে তাদের এ ঐতিহ্য।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বলতে হয় তুর্কেমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতের কথা। আশগাবাতকে বলা হয় ‘সাদা শহর’। অবশ্য এ উপাধির কারণও আছে। রাজধানী আশগাবাতের সকল দালান-কোঠা সাজানো সাদা মার্বেল পাথরে। এমনকি রাজধানীতে নির্মিত সকল ভাস্কর্য, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট বা রেলিং, ফুটপাত পর্যন্ত সাদা মার্বেলে তৈরি। এ কারণেই এ শহরের উপাধি হোয়াইট সিটি বা সাদা মার্বেলের শহর।
সাদা মার্বেল শহর হওয়ার পেছনের কারণটা বেশ দুঃখজনক। ১৯৪৮ সালে আশগাবাতে এক প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প আঘাত হানে। আশগাবাতে তখন প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস ছিল। মাত্র ২০ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে নিহত হয় এক লাখ দশ হাজার মানুষ। মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার সকল দালান, বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট সবকিছু। পুরো রাজধানী সামান্য সময়ের ব্যবধানে পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীর ধ্বংসস্তূপে।

তুর্কেমেনিস্তান তখন ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার একটি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র। প্রায় ৯৩ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ তুর্কেমেনিস্তান। প্রাকৃতিক গ্যাস, মার্বেল পাথর, ধাতব খনিজসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। রাশিয়া এখান থেকে সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে উন্নয়ন করতো মস্কো এবং লেলিনগ্রাদের।
মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের উন্নয়ন বা অগ্রগতির জন্য কম্যুনিজমপুষ্ট রাশিয়ার তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পের পর তাই কয়েক দশক ধরে ধুঁকতে থাকে আশগাবাত।
অবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন হয় বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। তুর্কেমেনিস্তান তাদের একটি। স্বাধীনতার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট হন তুর্কেমেনিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা সাপারমুরাত আতায়েভিচ নিয়াজভ। তার হাত ধরেই মূলত যাত্রা শুরু হয় আধুনিক তুর্কেমেনিস্তানের।

১৯৪৮ সালে পুরো ধ্বংস হয়ে যাওয়া আশগাবাত নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই ঘোষণা দেন, যে শহর একদিন ধুলোয় মিশে গিয়েছিল, সে শহরকে আমি মার্বেল পাথরের সাদা নগরী করে গড়ে তুলবো।
তিনি তার কথা রেখেছিলেন। পুরো আশগাবাত নগরী গড়া হয়েছে সাদা মার্বেলে। সরকারি-বেসরকারি সকল ভবন-বাড়ি নির্মিত হয় মার্বেল পাথর দিয়ে। এটা সেখানকার রাষ্ট্রীয় আইন।
মার্বেল পাথর দিয়ে শহর বানিয়েই ক্ষান্ত হয়ে যায়নি তুর্কমেনরা। মার্বেল শহরকে পরিচ্ছন্ন আর তকতকে রাখতে রীতিমতো আইন আছে সেখানে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা দণ্ডনীয় অপরাধ। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও ময়লা ফেললে গুনতে হয় মোটা অংকের জরিমানা। এছাড়া বেলায় বেলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তো আছেই।
প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ দর্শনার্থী তুর্কেমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতে আসে এই সাদা শহর দেখতে। আশগাবাত তাদের নিরাশ করে না। শহরের সাদা সাদা দালান আর রাস্তাঘাট দেখে চমৎকৃত হন তারা।
