ওয়াজ-মাহফিলের বক্তা ও আয়োজকদের যেসব ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত

মাওলানা সাজিদুর রহমান। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল এবং ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার শায়খুল হাদিস। দ্বীনের বহুমুখী খেদমতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এ বরেণ্য আলেমের।

সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয়েছিল ওয়াজ-মাহফিলের নানা দিক নিয়ে। সেখানে তিনি ওয়াজের গুরুত্ব, বিষয়বস্তু, বক্তার যোগ্যতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন। ইসলাম টাইমসের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেন আতাউর রহমান খসরু


 

ইসলাম টাইমস : দ্বীন প্রচারে ওয়াজ-মাহফিল কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে অনেক সাধারণ মুসলমান ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারে, হালাল-হারাম চিনতে পারে। যাদের অনেকেই দ্বীনি শিক্ষা পাননি এবং যাদের এখন নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নেই, অবসর সময়ে-বাদ মাগরিব, বাদ এশা- ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে দ্বীনের জরুরি জ্ঞান অর্জন করতে পারে তারা। এ সময় ওয়াজ-মাহফিল না হলে তারা হয়তো গল্প করেই সময়টা নষ্ট করতো।

আর রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘ফরজ তথা জরুরি জ্ঞান অর্জন করা মুসলমানের জন্য ফরজ।’

অন্যদিকে উলামায়ে কেরামও দ্বীনের কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে যা তাদের দায়িত্ব ছিল।

ইসলাম টাইমস : কেউ যদি মাহফিলে অংশ নেন তাহলে সে কি ইলমে দ্বীন অর্জনের মর্যাদা লাভ করবে?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : যদি সে ইখলাসের সাথে অংশগ্রহণ করে এবং আমাদের বয়ানও তেমন হয় তবে আশা করি সে  ইলমে দ্বীন অর্জনের মর্যাদা পাবে। সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি জুমার নামাজের জন্য যাচ্ছিল। তার ব্যাপারে বলা হয়, তুমি আল্লাহর রাস্তায় রয়েছো। জুমার নামাজে গেলে যদি আল্লাহর রাস্তায় থাকা হয়, ওয়াজ-মাহফিল শুনতে গেলেও আশা করি আল্লাহর রাস্তায় থাকার আমল হবে, ইনশাআল্লাহ!

তবে আমাদের উচিত সুরের পেছনে না পড়ে ইসলামের ফরজ বিধান সংক্রান্ত বয়ান করা, ইসলামের সৌন্দর্য্য তুলে ধরা, ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠিত হলে কী লাভ আর না হলে কী ক্ষতি তা নিয়ে আলোচনা করা। এলোমেলো আলাচনা না করে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা। তাহলে শ্রোতাদের জরুরি জ্ঞান অর্জিত হবে।

ইসলাম টাইমস : বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বক্তাদের কোন কোন বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : প্রথমে আকাইদ তথা বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করতে হবে। এরপর ইবাদত ঠিক করতে হবে। তবে এ দুই বিষয়ে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামে আছে আখলাক (চরিত্র উন্নয়ন), ইসলামে আছে মুয়ামালাত (লেনদেন), ইসলামে আছে মুয়াশারাত (আচার-ব্যবহার)। ইসলাম হলো মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের সমন্বিত বিষয়। কোনো কিছুই ইসলামের বাইরে না। এজন্য আল্লাহ তায়ালা দোয়া শিখিয়েছেন, (অর্থ) ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ার হাসানাহ (শান্তি) ও আখেরাতের হাসানাহ (শান্তি) দান করুন।’

এজন্য সাধারণ মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত সুন্দর হয় এমন বিষয়গুলো সামনে রাখা উচিত বলে আমি মনে করছি।

ইসলাম টাইমস : মানুষের সামনে ওয়াজ করতে হলে বক্তার ন্যুনতম কতোটুকু ইলম বা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (অর্থ) ‘বলুন! এটা আমার পথ। আমি আল্লাহর পথে আহবান করি ‘বাসিরাহ’-এর সাথে।’ এখানে বাসিরাহ অর্থ জ্ঞান। ইলম ছাড়া দাওয়াত দেয়া চলবে না। আমাদের তাবলিগি সাথীরা দাওয়াত দিচ্ছেন। যতোটুকু জানেন ততোটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ভিন্ন কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলেই তারা ভুল করেন। আমি কালেমা শিখেছি কালেমার দাওয়াত দেবো, নামাজ শিখেছি নামাজের দাওয়াত দেবো।

ইমাম বুখারি রহ. একটি বাব (পরিচ্ছেদ) প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘বাবুল ইলম কবলাল কওলি ওয়াল আমল’ অর্থাৎ তুমি কথা বলার পূর্বে এবং আমল করার পূর্বে ইলম অর্জন কর। ইমাম বুখারি রহ. আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইলম দিয়ে শুরু করেছেন’। বোঝা গেলো, কুরআন-হাদিসের যথাযথ জ্ঞান না থাকলে দাওয়াতের কাজ করা যাবে না, ওয়াজ করা যাবে না। বিশেষত এভাবে ওয়াজ করা আমি উচিত মনে করি না।

ইসলাম টাইমস : ইলম পরিমাপের জন্য দ্বীনিশিক্ষার কোনো স্তরকে মাপকাঠি হিসেবে ধরা যায়?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : বর্তমান যুগে কমপক্ষে দাওরায়ে হাদিস পাশ করতে হবে। আসলে শিক্ষার স্তর দিয়ে ইলম পরিমাপও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। কারণ, দাওরা পাশদের মধ্যে যোগ্যতার ফারাক অনেক। আবার কেউ কেউ তো সার্টিফিকেট জাল করেও নানান জায়গায় ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের সামনেও এমন একটি বিষয় কিছুদিন আগে ধরা পড়েছে।

সুতরাং বলা যায়, দাওরায়ে হাদিস পড়লে যতোটুকু যোগ্যতা হওয়ার কথা সে যোগ্যতা নিয়ে সে যদি দাওরা পাশ করতে পারে তবে সে ওয়াজ করতে পারবে।

ইসলাম টাইমস : কারো যদি যথাযথ জ্ঞান না থাকে এবং সে বয়ান করে তাহলে তার কী ক্ষতি আর উম্মতের কী ক্ষতি হবে?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : উম্মতের ক্ষতি হলো, সে নিজে পথভ্রষ্ট হবে এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে। হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ মূর্খদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে এবং তাদের কাছে মাসয়ালা জানতে চাইবে। ফলে সে নিজে গোমরাহ হবে এবং অন্যকেও গোমরাহ করবে।’ উম্মতের মারাত্মক ক্ষতি হবে।

ইসলাম টাইমস : এ ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় কী?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : বাঁচার একটা উপায় হলো, কারা বয়ান করতে পারবে এবং কারা পারবে না নির্ধারণ করতে শীর্ষ আলেমদের একটি বোর্ড গঠন করা যায়। তারাই তাদের পরীক্ষা নেবেন এবং সার্কিফিকেট দিবেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমন ব্যবস্থা আছে। আমরা একবার হাটহাজারীর হজরতকে প্রধান করে এমন একটি কমিটিও প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।

এখন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইলমহীন অনেক বক্তা সুর দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করছে এবং ইলমি মানুষের মূল্য কমে যাচ্ছে। যোগ্যতার বিচারে ওয়াজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে জ্ঞানী মানুষের মূল্যায়ন হতো এবং সুরের বাজারও গরম হতো না।

ইসলাম টাইমস : বক্তা নির্বাচনে আয়োজকদের কোন কোন বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : এক. ইলম বা দ্বীনি জ্ঞান থাকা, দুই. আমল থাকা, তিন. তাকওয়া-পরহেজগারি থাকা, চার. সুন্নাতের অনুসারী হওয়া ইত্যাদি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইসলাম টাইমস : বক্তাদের কোন বিষয়টা আপনাকে কষ্ট দেয়?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : অনেক বক্তার আখলাকের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করে। তাদের আচার-আচরণ, চলাফেরাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ বিরক্তি প্রকাশ করে। অনেক সময় সাধারণ মানুষের আখলাক দেখে মানুষ মুগ্ধ হয় আর আলেমের ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করে। বক্তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে। একজন দ্বীনের দাঈ হিসেবে এটা কখনও উচিৎ নয়।

এ বিষয়ে আরেকটি সাক্ষাৎকার পড়ুন : মাহফিলের আলোচনায় অতি প্রশংসা ও অতি উত্তেজনা কোনোটাই থাকা উচিত নয় : মুফতি হিফজুর রহমান

ইসলাম টাইমস : বক্তা তার আখলাককে কীভাবে সুন্দর করবে?

মাওলানা সাজিদুর রহমান : আল্লাহ তায়ালা বলেন, (অর্থ) তার চেয়ে উত্তম কে হতে পারে যে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করে এবং উত্তম আমল করে। আর বলে আমি একজন সাধারণ মুসলিম।’

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, বক্তার বৈশিষ্ট্য হবে সে মানুষকে সৎপথে ডাকবে, নিজে আমল করবে এবং নিজেকে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে তুলে ধরবে। ওয়াজ করে আমি বক্তা, আমির, শায়খুল হাদিস ও মাওলানা হয়ে গেলাম-আমাদের ভাবপ্রকাশে এগুলো থাকা উচিত নয়। বক্তার আচরণে আখলাক ও বিনয় প্রকাশ পাবে। যদি কেউ এই গুণ অর্জন করতে পারে ইমাম হাসান বসরি রহ. বলেন, এ ব্যক্তি আল্লাহর ওলি হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কবুল করুন। আমিন।

পূর্ববর্তি সংবাদদলীয় প্রার্থীকে মেনে নিতে হবে : শেখ হাসিনা
পরবর্তি সংবাদসেনাবাহিনীর জেনারেলকে সৌদিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ