গত ২৭ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ লোকসভায় পাশ হওয়া ‘মুসলিম নারী (বৈবাহিক অধিকার সংরক্ষণ) বিল-২০১৮’-কে দেশটির বিভিন্ন সমাজের প্রতিনিধিরা মুসলিম নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করছেন। বিলটি ‘তিন তালাক বিল’ নামেই অধিক পরিচিত।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন লোকসভায় পাশ হওয়া এই আইনে তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনানুযায়ী বিচারক তিন তালাক প্রদানকারী মুসলিম স্বামীকে সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল দিতে পারবেন।
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ অধিকাংশ বিরোধী দল এই বিলের বিরোধীতা করে। তাদের মত উপেক্ষা করে বিলটি কণ্ঠভোটে পাশ করানোর উদ্যোগ নিলে বিরোধী সদস্যরা ওয়াকআউট করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দের মোহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানী এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, ভারতের সংবিধান আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দেয়। বিয়ে-তালাক একান্ত ধর্মীয় বিষয়। এই বিষয়ে কোনো সরকারের হস্তক্ষেপই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের এই উদ্যোগ ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানী বলেছেন, সরকারের আচরণ সন্দেহজনক। আমরা এই সরকারকে বিশ্বাস করি না। খুব বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে তিন তালাক বিলটি পাশ করা হয়েছে। এটা সরকারের একটি অন্যায় কাজ।
আরও পড়ুন : প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতের লোকসভায় বিতর্কিত ‘তিন তালাক’ আইন পাশ
তিনি বলেন, এই বিল সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডার অন্তর্ভূক্ত। সরকার জনগণকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। যা পূরণ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং সরকার অন্য কৌশলে সমর্থকদের সন্তুষ্ট করতে চাইছে।
অল ইন্ডিয়া মাজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ‘মুসলিম নারী (বৈবাহিক অধিকার রক্ষা) বিল-২০১৮’-এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই, আপনাদের কী সমস্যা ছিলো? সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে আর আপনারা তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেছেন। এটা কেন করা হচ্ছে? এটা কী আমাদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য করা হচ্ছে? সাবরিমালা ইস্যুতে আদালত ধর্মীয় বিশ্বাসকে গ্রহণ করেছেন। তাহলে আমাদের বিশ্বাস কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? আপনাদের বিশ্বাস যদি আপনাদের হয়, আমাদের বিশ্বাস কেন আমাদের হতে পারবে না?
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সনাল ল’ বোর্ডের সদস্য কামাল ফারুকি বলেছেন, এটি সরকারের মুসলিম নিপীড়নের আরেকটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজকে হেনস্থা করবে এবং তাদেরকে চাপে রাখবে।
তিনি আরও বলেন, ভারতে অন্য যে কোনো সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলিম সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ কম। বরং বিজেপি তার কট্টর হিন্দু সমর্থকদের বোঝালো আমরা মুসলিমদের আরেকটু ক্ষতি করলাম। অবশ্য মুসলমানের ক্ষতি করা বিজেপির ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তারা মুসলমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, গো-হত্যার নামে মুসলিম নিধন করছে।
অল ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন (চল্লিশটি নারী অধিকার সংগঠনের জোট) এই বিলকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ হিসেবে উল্লেখ করে বলে এর মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন নেত্রী কবিতা কৃষ্ণ বলেছেন, এটা বিজেপির একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা। সরকার জেন্ডার ইস্যুকেও সাম্প্রদায়িক রূপ দিচ্ছে। বিজেপি এই আইন মুসলিম নারীর অধিকার রক্ষার জন্য করেনি; বরং মুসলিম পুরুষদের আঘাত করার জন্য করেছে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম উইমেন পার্সনাল ল’ বোর্ডের সভাপতি শায়েস্তা আম্বর বলেছেন, আমি যদি এই বিলকে প্রত্যাখ্যান করছি। যদিও এই বিলের একটি ইতিবাচক দিক হলো তা মুসলিম পুরুষদের তালাকের ব্যাপারে সতর্ক করবে।
দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ড. জাফারুল ইসলাম খান বলেছেন, অন্য ধর্মের একান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বিজেপি সরকার ভুল করেছে। মুসলিম সমাজে এর কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পড়বে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বিজেপি সরকার তার হিন্দু সমর্থকদের বোঝাতে চায় যে, তারা মুসলিমদের কোণঠাসা করছে। বিজেপি সরকার বিগত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। তাই সরকার তার কট্টর হিন্দু সমর্থকদের অন্তত এতোটুকু বোঝাতে চায় যে, মুসলিমদের তোমরা যেখানে দেখতে চাও আমরা সেখানেই তাদের নিয়ে যাচ্ছি।
বিলটি এখন পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে পাঠানো হবে। যেখানে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, কংগ্রেস বিলটি প্রত্যাখ্যান করবে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র টম ভাদাখান জানিয়েছেন, দলের কোর কমিটি বিলটির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে অতি শীঘ্রই বৈঠকে বসবেন।
সূত্র : আরব নিউজ ও মিল্লাত টাইম থেকে আবরার আবদুল্লাহ-এর অনুবাদ
