মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.: আমাদের শৈশব-কৈশোরের এক মহীরুহ 

শরীফ মুহাম্মদ ।।

তাঁকেই আমরা সবার চেয়ে বেশি দেখেছি। সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের শৈশব-কৈশোরে এত বড় বুযুর্গ আলেমকে এতটা বেশি কাছে পাওয়ার সুযোগ আমাদের আর হয়নি। অবুঝ বয়সে দেখেছি, যখন কিছুই বুঝি না মনীষা, ব্যক্তিত্ব ও আলেমসত্ত্বার বিশেষত্ব। আবার একটু একটু বুঝ হওয়ার পরও তাকে দেখেছি। সবসময়ই ছিলেন তিনি একরকম। নিয়ম ধরে চলা, সরল, সাদামাটা একজন কম কথা বলা ‍বুযুর্গ-ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি হযরত মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.। ময়মনসিংহে নিকট অতীতে দ্বীনী মাদরাসা নামের বাগিচা গড়ার কারিগর।

জীবনের শেষ বেলায় শহরের পশ্চিম প্রান্তে গড়ে তুলেছেন জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম ময়মনসিংহ। যৌবন থেকেই মাদরাসা গড়ার এই মহান কারিগর তাঁর জীবনজুড়ে ময়মনসিংহ শহর ও আশপাশে গড়ে তুলেছেন আরো কয়েকটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আব্বা-আম্মার মুখের ডাকে তিনি তাদের ‘মামু’। আমাদের মুখে মুখে ছিলেন- নানা। আমার আপন নানাকে আমরা হারিয়েছি অবুঝ শৈশবেই। কিন্তু নানা মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.-ই ছিলেন আমাদের প্রতিদিনের দেখা নানা। আমার নানির মা আর মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.-এর বাবা ছিলেন আপন ভাইবোন। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন আমাদের আপন নানার মতো। তাঁকে দেখা হতো বাসা থেকে বের হলেও, মসজিদেও দেখা হতো, দেখা হতো আমাদের বাসায়ও।

এত এত বিশেষত্বের অধিকারী এই মনীষী ছিলেন বাহ্যিক বেশভূষায় একদমই বিশেষত্বহীন। সাদামাটা, সাদাসিধা পোশাক ও জীবন তাঁর। গায়ে আকাশি, সবুজ কিংবা হালকা নীল কালারের নিসফে সাক জুব্বা। মাথায় পাঁচকল্লি ‍টুপি আর পায়ে প্লাস্টিকের কালো কিংবা অফ হোয়াইট নাগড়া জুতা। ঘরে, বাইরে, আচার-অনুষ্ঠানে, সবসময়। কত কত আলেমের তিনি উস্তায, কত কত মাদরাসার তিনি প্রতিষ্ঠাতা, কত কত মানুষের তিনি বরেণ্য- তারপরও তার জীবনের এই ‘সাদেগি’ কোনোদিন বদলায়নি।

১৯১৭ সালে জন্ম মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.-এর। ইন্তেকাল করেছেন ১৯৯১-এর ২৭ ডিসেম্বর। আমরা পেয়েছি তাঁকে ৭৬-৭৭ থেকে তাঁর চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। তার ৬০ বছর বয়স থেকে আমাদের দেখা। সচল বৃদ্ধ এক ‍বুযুর্গ হিসেবেই আমাদের তাঁকে দেখা শুরু। আগাগোড়া একরকম একজন নীতিনিষ্ঠ মানুষ, সততা-সচ্ছতা ও সরলতা নিয়ে চলা এক দৃঢ়চেতা আলেম ব্যক্তিত্ব। ছিলেন ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র। সেখান থেকে বড় কাটরা মাদরাসায় ভর্তি হন। তারপর চলে যান ভারতের সাহারানপুর। দ্বীনী ইলম অর্জনের অদম্য প্রেরণায় যৌবনের শুরুতে পথবদলের এবং পথপ্রাপ্তির সূত্রটি বেছে নিয়েছিলেন। জাগতিক অনেক দুঃখ-সুখেও সরে যাননি সে পথ থেকে, সে সূত্র থেকে। বরং সেই পথ ও সুত্রেরই নানারকম পবিত্র আঙিনা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছেন।

তাঁকে নিয়ে আমাদের স্মৃতির তো শেষ নেই। আমাদের শৈশব-কৈশোরের মহীরুহ ছিলেন তিনি। কতবার তাঁকে মাদরাসার কাজে শহরে দেখেছি, ফেরার সময় অন্যের সঙ্গে রিকশায় আসন ভাগাভাগি করে বসেছেন। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন রাস্তার পাশ ধরে। মসজিদে নামাজের পর আপন আত্মীয় স্বজনের মধ্যে মৃদু ভাষায় কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আখেরাতের পথনির্দেশ করেছেন। হাসিখুশি মুখাবয়বের চেয়ে বেশি দেখেছি গম্ভীর চিন্তাক্লিষ্ট দরদী চেহারা তাঁর।

বাড়ির দরকারী কাজে গেঞ্জি গায়ে-গামছা মাথায় পেচিয়ে কাজ করছেন। আবার সবকিছুর মধ্যেই নামাজের জামাতে আগে আগে মসজিদের দিকে ছুটেছেন বেচাইন হয়ে।তিনি বাড়িতে অথচ জামাতের জন্য মসজিদে আসেননি, এটা সম্ভবত জীবনে কখনো হয়নি। আমাদের মতো নাতি ও নাতিতুল্য শিশু-কিশোরের দলকে মাঠের খেলা থামিয়ে মসজিদে এনে উঠানোর ক্ষেত্রে আহবান ও শাসনের ভূমিকা রেখেছেন।

দ্বীনের দীক্ষা ও দীক্ষাদান ছাড়া তাঁর বড় কোনো পেরেশানি ছিল না, নিমগ্নতা ছিল না। বক্তব্যদানের মতো করে বক্তৃতা করতে শুনিনি তাঁকে। শুনেছি তাঁর দরদী কথা, উদ্বেগমাখা নসিহতের বাক্য। দাঁড়িয়ে, বসে, চলা-ফেরায় তিনি একই রকম ছিলেন। দ্বীনী ইলমের বাগান সাজানো ছিল তাঁর স্বপ্ন। দ্বীনের পথে শিক্ষক, দাঈ আর পথনির্দেশকের ভূমিকাই রেখে গেছেন জীবনভর।

আমাদের শৈশব-কৈশোরের এক বিম্ময়কর সৌভাগ্য হলো, বেশ কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিন ফজরের পর এই বরেণ্য সাধক ‍বুযুর্গ মানুষটি কিছু সময়ের জন্য আমাদের বাসায় আসতেন। সকালের চা-বিস্কুট-মুড়ির দস্তরখানে বসে ঘণ্টা-আধাঘন্টা সময় অত্যন্ত যত্নের সাথে কাটাতেন। আব্বা তাঁর সঙ্গে বসতেন। আমরা আশেপাশে ঘুর ঘুর করতাম। আম্মা ভিতর থেকে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। বাহ্যিকভাবে শুধুই চা-পানের এই মজলিসটিতেও তিনি দ্বীনের দরকারী বহু কথা বলে যেতে থাকতেন।

 

পূর্ববর্তি সংবাদভারতে পাঁচতারকা হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
পরবর্তি সংবাদমার্কিন সৈন্যদেরকে সিরিয়ান কুর্দীদের আলু নিক্ষেপ (ভিডিও)